কর্মক্ষেত্রের কিছু স্মৃতি

ডা. মাহমুদুল হাসান
2023-07-06 21:08:29
কর্মক্ষেত্রের কিছু স্মৃতি

কর্মক্ষেত্রের কিছু স্মৃতিচারণ করেছেন ডা. মাহমুদুল হাসান

আমার তিনটা কর্মক্ষেত্রের কিছু স্মৃতি উপস্থাপন করবো।

১. চাকুরী শুরু করি (১৯৮৯তে) কুমুদিনী হাসপাতালে। ইংরেজদের নিয়মকানুন দিয়ে পরিচালিত হত এই হাসপাতাল। অনেকটা দূর্গের মতো! ভিসিটিং এর সময় বাদে কেউ ভিতরে ঢুকতে পারতো না। ভর্তির সময় আমরা যে কাউন্সেলিং করতাম সেটার বড় কোন পরিবর্তন হলেই শুধু রোগীর লোকজনকে ডাকা হত। গেটের পাশে অভ্যর্থনায় যে কেউ রোগী সম্পর্কে জানতে চাইলে, খোজ নিয়ে জানানো হত। তাই বাইরের ঝড়-ঝঞ্ঝা আমাদের বোঝার উপায় ছিল না।

কিন্তু ভিতরে ঝড় ছিল টাইফুন! প্রত্যেকটা কাজের প্রটোকল ছিল, এর বাইরে এক বিন্দু নড়লে কড়া জবাবদিহিতা। সামান্যতম অবহেলার জন্য পত্রপাঠ বিদায়। তাই সীমিত সাধ্যে সর্বোচ্চ চিকিৎসা দেয়া সম্ভব হত।
মাথার উপর শক্ত ছাতা ছিল কুমুদিনী কর্তৃপক্ষ।

২. জামালপুর জেনারেল হাসপাতালে কাজ শুরু করি (১৯৯৩তে) অত্যন্ত শ্রদ্ধাভাজন অধ্যাপক আব্দুল গফুর স্যারের অধীনে। জিয়া হেলথ কমপ্লেক্সে যেমন ডা. জিয়াউল হক ছাতা ছিলেন, সরকারি হাসপাতালে ছাতা ছিলেন সিভিল সার্জন জনাব আশকর আলী। আমি যোগদানের কিছুদিন পরই আব্দুল গফুর স্যার ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজে বদলী হন। আশকর স্যার আমাকে ডেকে নিয়ে বলেন "আমি জানি এই হাসপাতালে সচারাচর যে সকল সার্জারী হয়, সবই তুমি একাকী করতে পারো, এখন থেকে এই বিভাগের দায়িত্ব তোমার। কোন রোগী যেন অকারণে রেফার না হয়।"

আমি বললাম "স্যার, আমার তো পোস্ট গ্রাজুয়েশন করা নাই; কোন সমস্যা হলে?”
হেসে বললেন " আমি আসকর আলী আছি না!" একবার একটা মেডিকো লিগ্যাল বিষয়ে একজন আমাকে অন্যায় হুমকি দিয়েছিল। তাকে স্যার এমন শায়েস্তা করেন যে, সে পায়ে ধরে মাফ চেয়ে বেঁচেছে।
সেই গল্প আরেকদিন লিখবো।

এরপর দীর্ঘদিন কনসালট্যান্ট পোস্টিং হয়নি। আমি নির্বিঘ্নে কাজ করেছি। কোন চাপে থেমে থাকতে হয়নি।

আশকর স্যারের সময়ে সার্জারীর কোন রোগিকে ওষুধ, সেলাই উপকরণ কিনতে হত না। জামালপুরের স্বাস্থ্য বিভাগের প্রতিটা ভাল মন্দ তার নখদর্পনে থাকতো।
আমার উপর তার আস্থা আমাকে অনেক বেশি কর্তব্যপরায়ণ করেছে।

৩. নিজে যখন ছাতা, তখন সব ব্যর্থতার গল্প। উপজেলা স্বাস্থ্য কর্মকর্তা হিসাবে বছরখানেক চাকরি করেছি (২০১২ তে)। এখানে প্রধান ব্যক্তি হয়েও আমি অনেক কিছু পারিনি। হাসপাতালে হালকা পাতলা মারামারির রোগী ছাড়া কাউকে ভর্তি রাখা হত না। কনসালটেন্ট সহ কোন ডাক্তার উপজেলায় থাকতেন না। থাকার মত অবকাঠামোও ছিল না। উনাদের উপস্থিতি নিশ্চিত করাটাই কঠিন ছিল।

আমি ডাক্তারদের রোগী দেখার প্রতি মনোযোগ দিতে উৎসাহিত করতাম। রোগী ভর্তি করে নিজেদের উপর আস্থা বাড়াতে বলতাম। এতে করে হাসপাতালে রোগী ভর্তি বাড়তে লাগলো। উপজেলা পর্যায়ে ডাক্তারী চর্চার সুযোগ অনেক, সেটা প্রমোট করেছিলাম। কোন অসুবিধা হলে আমি তাদের প্রটেকশন দিবো, নিশ্চয়তা দিয়েছিলাম।

জানি না এর আগে কোন উপজেলায় একাডেমিক আলোচনা চালু হয়েছিল কি না, আমি শুরু করেছিলাম। পোষ্ট গ্রাজুয়েশন করার জন্য উৎসাহ দিয়েছি, এতে আমার প্রায় অর্ধেক মেডিকেল অফিসার আজ উচ্চতর শিক্ষায় শিক্ষিত।

তারপরও অনেক কিছু পারিনি, তবে চেষ্টা ছিল। ডাক্তারদের অনেকের মাঝে সেবা দেয়ার মানসিকতা থাকলেও সামগ্রিক সেটার প্রতিফলন দেখা যায়নি। সার্বিকভাবে উপজেলা হাসপাতালকে গ্রহনযোগ্য অবস্থানে নিতে পারিনি। হতে পারে লিডারশীপে ঘাটতি ছিল।

কর্মক্ষেত্রে নির্বিঘ্নে কাজ করতে পারলে প্রডাকটিভিটি অনেক বাড়ে। এতে হঠাৎ কিছু অনিয়ম হতে পারে, কিন্তু সেটাও নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব। বর্তমানে চিকিৎসাক্ষেত্রে যে আস্থাহীনতা, অস্থিরতা সেটা কাটিয়ে উঠার জন্য প্রয়োজন নিরাপদ কর্মক্ষেত্র। এটার জন্য প্রথম প্রয়োজন দক্ষ ব্যবস্থাপনা।

আমার সরকারি চাকুরির শুরু এবং শেষটা ছিল হতাশাজনক। প্রথম কর্মক্ষেত্রে একজনের নেতিবাচক আচরনে সবাই অতিষ্ঠ ছিলাম কিন্তু শেষ বেলায় মনে হয়েছে যে গড্ডালিকায় গা না ভাসিয়ে আমিই ভুল পথে চলছি!

পুনশ্চ: মাঝের প্রায় সবগুলো কর্মক্ষেত্রে অনেক ভাল ও যোগ্য প্রশাসক পেয়েছি, ভাল গাইড পেয়েছি। ভাল পরিবেশে কাজ করেছি। উনাদের সম্পর্কে আলাদাভাবে লিখবো ইন-শা-আল্লাহ।

লেখক :

ডা. মাহমুদুল হাসান, 

অবসরপ্রাপ্ত সহকারী অধ্যাপক, শিশু সার্জারী বিভাগ।


আরও দেখুন: