আঁখি নামের মেয়েটির মৃত্যু যদি অস্ট্রেলিয়াতে হতো
মাহবুবা রহমান আঁখি
মনে করুন আঁখির মত একটা মেয়ে অস্ট্রেলিয়াতে নরমাল ডেলিভারি কিংবা সিজারিয়ান অপারেশনের পর মারা গেলো। এইসব ঘটনার পর এই দেশে কি হয় একটু বলি। তাহলে বুঝতে পারবেন আমাদের মূল সমস্যাটি কোথায় এবং আমাদের করণীয় কি?
আমি গত এক যুগ অস্ট্রেলিয়াতে আছি এবং একজন চিকিৎসক হিসাবে কাজ করছি। আমি এখানে যা লিখছি, শত ভাগ সত্যি তুলে ধরার চেষ্টা করবো।
আঁখি নামের মেয়েটির মৃত্যু যদি অস্ট্রেলিয়াতে হতো তাহলে সর্বপ্রথম অস্ট্রেলিয়ার গভর্নর জেনারেলের অফিস আঁখির চিকিৎসক ও হাসপাতালের নামে একটা রিপোর্ট করে দিতো। আবারো বলছি শব্দটি রিপোর্ট, মামলা নয়।
অস্ট্রেলিয়াতে নিয়ম হলো কোন রোগী হাসপাতালে যেকোন অপারেশনের পর মৃত্যু হলে সেই মৃত্যুর অবশ্যই তদন্ত হবে। এইটি রাষ্ট্রের দায়িত্ব। এখানে রোগীর লোকের চাওয়া- না চাওয়া বলে কিছু নেই। এই মৃত্যুর তদন্ত হওয়া বাধ্যতামূলক। এইসব দেশে প্রতিটা নাগরিকের সুরক্ষার দায়িত্ব রাষ্ট্রের এবং সুবিচার প্রতিষ্ঠা করে দেয়ার জন্য আছেন গভর্নর জেনারেল।
এই রিপোর্ট হবে করোনার কোর্টে। যদি কোন হাসপাতাল কিংবা সার্জন এই রোগীর মৃত্যুর কথা করোনারকে ইনফর্ম না করেন, তাহলে সেটি হবে শাস্তি যোগ্য অপরাধ। সুতরাং এইসব দেশের নাগরিকগণ খুব ভালো করেই জানেন যে, যদি তার উপর কেউ কোন অন্যায় করে থাকে তবে সে মরে গেলেও তার সুবিচার হবে।
রাষ্ট্র তার পক্ষ নিয়ে লড়বে।
এইখানে একটা জিনিস বলে রাখি, এই যে রিপোর্ট করা, তদন্ত, কোর্ট ও মামলার কাজকর্ম সবকিছুই হবে খুবই গোপন ভাবে। ক্লোজ ডোর কোর্ট। শুধুমাত্র ডাক্তার নিজে, হাসপাতালের ডিরেক্টর এবং রোগীর দুই-একজন লোক ছাড়া এই তদন্ত ও মামলা সম্পর্কে কেউ জানতে পারবেনা। সাংবাদিক ও মিডিয়া জানার তো প্রশ্নই উঠেনা।
কেন এই কঠিন গোপনতা সেটা বলি, কারণ হলো- যদি কোন কারণে রোগীর লোকজন কিংবা রাষ্ট্র এই সব ঘটনা মিডিয়াতে প্রকাশ করে, আর ডাক্তার যদি নির্দোষ প্রমাণিত হন তাহলে তিনি রোগীর লোকজন অথবা রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে মানহানির মামলা করে দিবেন। রোগীর ক্ষতি পূরণের মামলা যদি হয় এক মিলিয়ন, ডাক্তার মানহানির মামলা দিবেন পাঁচ মিলিয়ন। সুতরাং এখানে দুই পক্ষই খুব সাবধানে থাকেন।
কোর্টে ফরেনসিক বিশেষজ্ঞ ও তৃতীয় পক্ষের নিরপেক্ষ স্পেসালিস্ট ডাক্তার, আইনবিদ ও জুরি বোর্ড থাকেন। এমনকি জটিল কেসের ক্ষেত্রে বিদেশী বিশেষজ্ঞদের মতামতও নেয়া হয়।
এখানে তদন্ত শুরু হবে রোগীর ঘর থেকে। কখন সে ব্যথার কথা বলেছে, কাকে সর্ব প্রথম সে জানিয়েছে? কি ব্যবস্থা নেয়া হয়েছিল? নিকটবর্তী কোন ডাক্তার কিংবা নার্সের পরামর্শ নেয়া হয়েছে কিনা? কি এডভাইস দেয়া হয়েছিল? সেই পরামর্শকে অনুসরণ করা হয়েছে কিনা? না মেনে থাকলে কেন করা হয়নি? কিসের প্রতিবন্ধকতা ছিলো? বড় হাসপাতালে কেন আসতে হলো? কিভাবে এসেছে? নিজের গাড়ি নাকি এম্বুলেন্স? এম্বুলেন্স দেরি হলো কিনা? দেরি হয়ে থাকলে কেন দেরি হলো, এইটি জানতে এম্বুলেন্সের ড্রাইভারকে ডাকা হবে। কে হাসপাতালে রিসিভ করলো? প্রাথমিক চিকিৎসা কি দেয়া হয়েছে? কোন ডাক্তার, কখন এবং কেন দেখেছেন? কি ব্যবস্থা নিয়েছেন? অপারেশনের সময় কি ধরনের কমপ্লিকেশন হলো? কেন হলো? এইসব বিস্তারিত আলোচনা ও গবেষণা হবে। প্রতিটা পদক্ষেপকে সুক্ষভাবে বিশ্লেষণ করা হবে।
তারপর কার কোথায় অবহেলা এবং ভুল ভ্রান্তি হয়েছে এই বিষয়ে করোনার একটা রিপোর্ট তৈরি করবে। এই রিপোর্টে একটা বড় অংশ থাকে পরিকল্পনা ও উপদেশ। ভবিষ্যতে কখনো যেন আঁখির মত কোন মায়ের অকাল মৃত্যু না হয়- এইজন্য একটা পরিকল্পনা ও গাইডলাইন তৈরি করা হবে। যদি ডাক্তারদের আরো ট্রেনিংয়ের প্রয়োজন মনে করা হয়, তবে সেটা আয়োজন করা হয়। যদি ডাক্তারের বড় ধরনের অবহেলা প্রমাণিত হয়. তবে সেই ডাক্তারের লাইসেন্স বাতিল করা হয়। ডাক্তারের ইন্সুরেন্স কোম্পানি থেকে রোগীর ক্ষতিপূরণ দেয়া হয়। ডাক্তারের অপরাধ অনুসারে জেল হয়। আর যদি ডাক্তার নির্দোষ প্রমাণিত হন তবে তাকেও তার মানহানির ক্ষতি-পূরণ দেয়া হয়। যদি রোগীর লোকজনের অবহেলা খুঁজে পাওয়া যায়, তবে তাদেরও শাস্তির ব্যবস্থা করা হয়।
যখন মামলার ফাইনাল রিপোর্ট হয় তখন সেটা মিডিয়াতে প্রকাশ করা হয়। যদি রোগীর লোকজনের অবহেলা থাকে তবে সেটা জনসাধারণকে জানানো হয়, যেন কেউ ভুলবশতঃ এই অবহেলা না করেন। রিপোর্টের একটা কপি দেশের সব ডাক্তার ও হাসপাতালে পাঠানোর ব্যবস্থা করা হয়, যাতে ডাক্তারগণ এই বিষয়ে অবগত থাকেন এবং সতর্ক হন।
একটা আলাদা কমিটি করা হয়, যারা পরবর্তী কয়েক বছর এই রিপোর্টের পরিকল্পনা ও গাইডলাইন বাস্তবায়ন হয়েছে কিনা সেটা পর্যবেক্ষণ ও ফলো আপ করে থাকেন।
বিশ্বাস করুন সত্যি বলছি, অস্ট্রেলিয়াতে ঠিক এইভাবে প্রতিটি অপ্রত্যাশিত মৃত্যুকে তদন্ত করা হয়।
কিন্তু দুঃখের বিষয় হলো,
আঁখি নামের মেয়েটি কারো না কারো অবহেলা ও অযত্নে মৃত্যু বরণ করেছে। কিন্তু আজ পর্যন্ত রাষ্ট্র তার সুরক্ষা ও সুবিচারের জন্য বিন্দুমাত্র কোন পদক্ষেপ নেয়নি। আঁখিকে বাঁচিয়ে রাখার জন্য যে জুনিয়র ডিউটি ডাক্তার মেয়েটি যথাসাধ্য চেষ্টা করলো সেই মেয়েটি আবার কোন বিচার প্রক্রিয়া ছাড়াই জেলে পড়ে থাকলো। এই অন্যায় ও অবিচার থেকে আরেকটি মেয়েকে বাঁচানোর জন্য রাষ্ট্র ও তথাকথিত চিকিৎসক সংগঠন কেউ এগিয়ে আসলোনা। এইভাবে আর কোন মায়ের মৃত্যু যেন না হয়, সেই বিষয়ে কোন উচ্চ পর্যায়ে আলোচনা ও গবেষণা হলো না।
তাহলে কি দাঁড়ালো? এই দেশে কি ডাক্তার, রোগী ও সাধারণ নাগরিক কারো জীবনের কোন মূল্য নেই?
এইভাবে আর কত দিন?
একটা কথা বলে রাখা উচিত, এইখানে রাষ্ট্র মানে আওয়ামী লীগ-বি এনপি নয়। রাষ্ট্র মানে আমরা সবাই।
রাষ্ট্রের ব্যর্থতা মানে আমাদের সকলের ব্যর্থতা। ডাক্তার ও রোগী কেউ এই ব্যর্থতার দায় এড়াতে পারবেনা।
আঁখি নামে একটা মেয়ে মরে গেছে। কিন্তু অন্য নামে এখনো আমাদের অনেক বোন আছে, মা আছে, কারো সন্তান আছে। একটা মেয়ের মৃত্যুর কারণ থেকে শিক্ষা নিয়ে আমরা যদি অন্য আরেকটা মেয়েকে বাঁচাতে পারি, তবে হয়তো সামান্য হলেও এই অপরাধের প্রায়শ্চিত্ত হবে।
লেখক:
ডা. শামছুল আলম
মেলবোর্ন, অস্ট্রেলিয়া।
২৭ /০৬ /২০২৩