গ্রামে প্রসূতি সেবা শহরের চেয়ে নিরাপদ
গ্রামে প্রসূতি সেবা শহরের চেয়ে বেশি নিরাপদ (লেখক : ডা. মারুফুর রহমান অপু)
চিকিৎসক হিসেবে আমার ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতায় সব সময়েই মনে হয়েছে, গ্রামে প্রসূতি সেবা শহরের চেয়ে বেশি নিরাপদ। উপজেলায় যেসব চিকিৎসক কাজ করেন তারা সম্ভবত আমার সাথে একমত হবেন।
যেকোন পণ্যের মতই চিকিৎসা সেবাটাও একটা পণ্য এবং এই পণ্যের বাণিজ্যিকিকরণ শহরগুলো অনেক অনেক বেশি। গ্রামে যে বাণিজ্য নেই তা নয় কিন্তু বাংলাদেশের স্বাস্থ্যসেবার সবচেয়ে শক্তিশালী অবস্থান কিন্তু গ্রামেই। আমি টারশিয়ারি হাসপাতালের কথা বলছিনা, প্রাইমারী ও সেকেন্ডারি কেয়ারের কথা বলছি।
আমাদের অনেক উপজেলায় অপারেশন থিয়েটার ও কনসালটেন্ট (গাইনী, সার্জারি, এনেস্থেশিওলজি) আছে, এন্টিনেটাল ও পোস্ট নেটাল চেকাপের ব্যাবস্থা আছে, উপজেলার নিচে ইউনিয়নে ডাক্তার আছে, মাঠ পর্যায়ে প্রশিক্ষিত স্কিলড বার্থ এটেন্ডেন্ট আছে, ফেমিলি প্ল্যানিং সার্ভিসের মাঠকর্মীরা আছেন এমনকি অনেক কমিউনিটি ক্লিনিকে নরমাল ডেলিভারির ব্যবস্থাও আছে। নরমাল ডেলিভারি মানুষের একটি স্বাভাবিক শারিরীক প্রক্রিয়া, এটা চিকিৎসকেরই করতে হবে এমন কোন কথা নেই। হ্যা, নানা কারণে নরমাল ডেলিভারির সাথে অনেক ঝুকির ব্যপার চলে আসে, সে কারনেই নিয়মিত এন্টিনেটাল চেকাপ করানো দরকার এবং সবকিছু ঠিক থাকলে একজন মিডওয়াইফ/স্কিল বার্থ এটেন্ডেন্ট নরমাল ডেলিভারি করাতে পারেন। ঝুকির সম্ভাবনা দেখা দিলে নিকটস্থ রেফারেল সেন্টারে পাঠাতে পারেন। উন্নত বিশ্বে এটাই হয়। বাংলাদেশেও উপজেলাগুলোতে অনেক যায়গাতেই এটা হয়। অবশ্য সেখানেও ব্যাঙের ছাতার মত গজিয়ে ওঠা প্রাইভেট ক্লিনিকগুলো এবং তাদের দালালদের অভাব নেই তাও সরকারি সেবা নেটওয়ার্ক যেখানে ভালো আছে সেখানে প্রচুর মানুষ প্রায় বিনামূল্যে এই সেবা পাচ্ছেন।
অন্যদিকে শহরে আমাদের এমন কোন নেটওয়ার্ক নেই। দুই কোটি মানুষের ঢাকায় আমাদের কোন প্রাইমারী কেয়ার নেটওয়ার্ক নেই। নেই কোন কমিউনিটি ক্লিনিক, নেই কোন প্রাইমারি কনটাক্ট সেন্টার। এখানে সেবা সব টারশিয়ারি হাসপাতাল কেন্দ্রিক। অল্প কিছু আরবান হেলথ সেন্টার যদিও বা আছে কিন্তু সেটা একেবারেই নগন্য। তাই স্বাভাবিকভাবেই একেবারে দরিদ্র জনগোষ্ঠী ছাড়া সরকারি সেবামুখী কেউ হয়না। লোকে নামী দামী ডাক্তারের চেম্বার খোজে, সেখান থেকে প্রাইভেট ক্লিনিক। গর্ভবতী হলে চেকাপের জন্য লোকে সেন্টারের নাম খোজেনা, বিশেষজ্ঞ ডাক্তারের নাম খোজে। সেই বিশেষজ্ঞ ডাক্তারও প্রতিযোগীতায় টিকে থাকার লড়াইয়ে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের সাথে চুক্তিবদ্ধ থাকেন আর সেখানেই রেফার করেন।
সম্প্রতি নরমাল ডেলিভারির মত একটি স্বাভাবিক প্রক্রিয়াকেও বাণিজ্যিকিকরণ করা হয়েছে। প্রথমে লক্ষ লক্ষ মা ও শিশুর ঝুকিপুর্ণ অবস্থা থেকে বাচিয়ে তোলা, জীবন রক্ষাকারী সিজারিয়ান সেকশন অপারেশনকে নেতিবাচকভাবে প্রচার করা হয়েছে যেন এটা একটা অপরাধ। অন্যদিকে নরমাল ডেলিভারি এবং ব্যাথামুক্ত নরমাল ডেলিভারি কে বাণিজ্যিকভাবে প্রচার করা হয়েছে যেন লোকে নির্দিষ্ট হাসপাতাল বা ডাক্তারের কাছে নরমাল ডেলিভারির জন্য যায়। এই বাণিজ্যিক ফাদে পড়ে শহরের লোকেরা কোন ম্যাডাম নরমাল ডেলিভারি করান বা কোন হাসপাতাল নরমাল ডেলিভারি করায় সেটা খোজেন।
আচ্ছা আপনি একটা অন্য শারিরীক অবস্থার কথা চিন্তা করুন তো। ধরেন স্ট্রোক হয়েছে, আপনি কি খোজেন যে কোন ডাক্তার বা কোন হাসপাতাল এই সমস্যাটি ওষুধে সারায় বা কে এটাকে অপারশনে সারায়? একজন গর্ভবতী নারীর সিজারিয়ান অপারশন লাগবে কিনা সেটি একজন চিকিৎসক নির্ধারন করবেন, নিয়মিত চেকাপে থাকলে এমবিবিএস চিকিৎসক এমনকি মিডওয়াইফ ও প্যারামেডিকরাও ঝুকি নির্ণয় করতে পারেন। তাহলে আপনি নরমাল ডেলিভারি করাবেন না সিজারিয়ান করাবেন সেটা ত পুরোপুরি আপনার নিজের এমনকি ডাক্তারেরও ইচ্ছাধীন নয়, আপনার শারিরীক অবস্থার উপর নির্ভরশীল। তাহলে কোন ডাক্তার বা হাসপাতাল যদি দাবী করে তারা নরমাল ডেলিভারি করায় সেটা কি প্রতারণা না? কেন নরমাল ডেলিভারি করান? কাদের করান? সবাইকেই, যার ঝুকি আছে তারও? যার ঝুকি আছে তাকে কি সিজার করবেন না? পরিস্থিতি খারাপ হলে আপনার হাসপাতালে ম্যানেজ করার সব ব্যবস্থা আছে? না থাকলে রেফারেল নেটওয়ার্ক আছে? এইসব নিশ্চিত না করে আপনি যদি "নরমাল ডেলিভারি" কে বাণিজ্যিক উদ্দেশ্যে প্রচার করেন তাহলে আপনার সাথে তো ঝারফুকওয়ালা ভন্ড কবিরাজদের কোন পার্থক্য নেই।
আমাদের শহরগুলোতে যে পরিমান বেসরকারি হাসপাতাল ও চেম্বার আছে এগুলো রেগুলেট করার মত সরকারি জনবল স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের নেই। শহরে টারশিয়ারি হাসপাতালগুলো বাদে কোন আরবান প্রাইমারী নেটওয়ার্ক ও স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের অধীনে নেই। অল্প কিছু আরবান কেয়ার সেন্টার এনজিও ও সিটিকর্পোরেশন/লোকাল গভমেন্ট এর আওতায় পরিচালিত হয়। তাহলে এই দিকে আমরা নজর দিচ্ছি না কেন?
গ্রামে একজন মানুষ মোটামুটিভাবে জানে যে গর্ভাবস্থায় কোথায় কয়বার চেকাপে যেতে হবে, ডেলিভারির জন্য কোথায় যাবে, সমস্যা হলে কোথায় যাবে, কি কি নিয়ে প্রস্তুত থাকতে হবে ইত্যাদি। সেখানে দালালের ফাদে না পড়লে কেউ আলাদা করে নরমাল ডেলিভারির ডাক্তার খোজেনা। এই ব্যাপারগুলো কি শহরে প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব? এ ব্যাপারে আমাদের নজর পড়বে কবে?
লেখক :
ডা. মো: মারুফুর রহমান
চিকিৎসক ও পিএইচডি গবেষক,
দ্যা ইউনিভার্সিটি অফ শেফিল্ড, যুক্তরাজ্য