কিছু কালো চেহারা রোগেও হয়!
পরীক্ষা-নিরীক্ষার মাধ্যমে জানা গেল ছেলেটির Addison disease
উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের বহিরাগত বিভাগে শতকরা ৯০ শতাংশ রোগীর মা আসেন ওষুধ নেওয়ার জন্য। বাচ্চা খায় না, ঠান্ডা-কাশি-জ্বর– এই একই অভিযোগ শুনতে শুনতে দিন পার হয়ে যায়।
রোগের চেয়ে কে কয়টা বেশি ওষুধ বগলদাবা করতে পারেন, তার দিকেই আগ্রহ বেশিরভাগ মায়ের। এর মধ্যে আসল রোগী খুঁজে বের করা দুষ্কর। অনেকটা খড়ের গোদায় সুই খোঁজার মতো।
মধ্য দুপুর আমি রোগী দেখছি, দরজা দিয়ে বাইরের দিকে চোখ পড়তেই ৯-১০ বছরের একটি ছেলেকে দেখলাম। দেখতেই মাইক্রো সেকেন্ডের জন্য চোখ তার দিকে থমকে গেল। ছেলেটি স্বাভাবিকের চেয়ে একটু বেশিই কৃষ্ণ বর্ণের। এর মধ্যে বাইরে অপেক্ষমাণ রোগীর মায়েদের মধ্যে কে লাইনে আগে এসেছেন, কে পরে– এ নিয়ে বিবাদ লেগে গেছে। এ বিবাদের সুযোগে এক মা তার বাচ্চা কোলে করে রুমে চলে এসেছেন, এসেই সেই চিরাচরিত অভিযোগ, ঠান্ডা-কাশি-জ্বর।
আমি: সমস্যা কত দিনের?
রোগীর মা: কাল রাত থেকে
আমি তার কোলের বাচ্চা দেখছি, এর মাঝেই রোগীর মা বাইরে দাঁড়িয়ে থাকা এক ছেলেকে দেখিয়ে বলছে ওর ও একই সমস্যা, কাল রাত থেকে জ্বর, প্যারাসিটামল দিয়ে দেন।
রোগীর মার ওষুধ নিতে এতই তাড়া যে সে বাইরে দাঁড়িয়ে থাকা ছেলেকে না দেখিয়েই ওষুধ নিয়ে কেটে পড়তে উদ্যত। আমি দরজার ওপারে তাকিয়ে দেখি সেই ছেলে। বললাম, ওকে ভেতরে আনেন।
বাচ্চার মা আবারও বলল: ওর খালি জ্বর, জ্বরের ওষুধ দেন।
আমি: ওকে আগে ভেতরে আনেন।
রোগীর মা কিছুটা অনিচ্ছাকৃতভাবে ওকে ভেতরে আনলেন।
আমি: ওর কি আর কোনো অসুখ আছে? কোনো ওষুধ খায়?
রোগীর মা: না।
ইতিমধ্যে রোগীর উপচে পড়া ভিড় বাইরে।
আমি মাকে বললাম: ছোট বাচ্চার ওষুধ নিচ থেকে নিয়ে উপরে এসে বসেন। আপনার সঙ্গে কথা বলব। যাবেন না কিন্তু।
রোগীর মা ছোট বাচ্চার ওষুধ নিতে নিচে চলে গেলে, মধ্যবর্তী সময়ে আমি বাকি রোগী দেখা শুরু করলাম আর বাইরের দিকে খেয়াল রাখলাম, সেই মা ফিরে আসে কিনা।
কিছুক্ষণ পর সেই মাকে দেখলাম বাচ্চা নিয়ে রুমের বাইরে এসে দাঁড়িয়েছেন। আমি রুম থেকে বাইরে গিয়ে তাকে বললাম, বসেন। রোগী কমে গেলে আপনার সঙ্গে কথা বলব। এত রোগী দেখে সে আবার চলে না যায়, এ জন্য তাকে গিয়ে একটি চেয়ারে বসিয়ে প্রায় আধ ঘণ্টা পর তাদের ভেতরে নিয়ে আসলাম।
আমি: ওর গায়ের রঙ কি এমনই, নাকি পরে হয়েছে?
মা লাজুক হাসি দিয়ে বললেন: হ, ও একটু কালোই আর একটু বেশিই দুর্বল।
আমি: সব সময়ই এমন কালো ছিল? এত বেশি কালো ছিল? কখনও অজ্ঞান হয়ে গিয়েছিল? হাসপাতালে ভর্তি ছিল? লবণ বেশি খেতে চায়?
এবার মা কিছুটা ভেবে বলল: না, ওর গায়ের রঙ গত ৩ বছর ধরে এমন বেশি কালো হয়ে যাচ্ছে। ৩ বছর আগে একবার জ্বর হয়ে অজ্ঞান হয়ে গিয়েছিল। এরপর হাসপাতালে ১২ দিন ভর্তি ছিল, তারপর থেকেই এমন কালো হয়ে যাচ্ছে।
মায়ের সঙ্গে কথা বলতে বলতে আমি ছেলেটির সাধারণ পরীক্ষা-নিরীক্ষা করতে লাগলাম। আমি: তখন হাসপাতাল থেকে ছুটি দেওয়ার সময় কি রোগ হয়েছে, তা বলে দিয়েছে?
মা: না।
আমি: এমন কোনো ওষুধ দিয়েছে, যা এখনো খাচ্ছে?
মা: না।
আমি: আপনার ছেলের একটা রোগ হয়েছে বলে আমি ধারণা করছি। এর জন্য কিছু পরীক্ষা-নিরীক্ষা দরকার হবে, যেগুলো এখানে হয় না। এর জন্য ভর্তিও থাকা লাগতে পারে। আমি আপনাকে ঠিকানা লিখে দিব, আপনি যাবেন?
রোগীর মা রাজি হলেন।
আমি সব রোগের ইতিহাস লিখে, অস্থায়ী রোগ নির্ণয় হিসেবে চিকিৎসা বিজ্ঞানের ভাষায় যাকে বলি Addison disease লিখে, বিএসএমএমইউতে পেডিয়াট্রিক অ্যান্ডোক্রাইনোলজির অধ্যাপক ও আমার শিক্ষক অধ্যাপক সুরাইয়া ম্যাডামের কাছে পাঠিয়ে দিলাম।
রোগী ভর্তি হলো এবং আরও পরীক্ষা-নিরীক্ষার মাধ্যমে জানা গেল এটা Addison disease। বিএসএমএমইউতে সুরাইয়া ম্যাডামের অধীনে পেডিয়াট্রিক অ্যান্ডোক্রাইনোলজিতে কাজ করার সুবাদে কিছুটা হলেও ব্যতিক্রমী এ রোগগুলো সহজে ধরা পড়ে। না হলে হয়তো দুই শতাধিক রোগীর ভিড়ে ও প্যারাসিটামল আবদারের তোড়ে এই রোগীও হারিয়ে যেত। শেষ খবর পাওয়া পর্যন্ত ছেলেটার নিয়মিত চিকিৎসা চলছে।
লেখক: ডা. ইসমাত আলো
এমডি, শিশুরোগ
মেডিকেল অফিসার, কেরানীগঞ্জ উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স, ঢাকা