শিশুদের অপচিকিৎসা দেখলে খুব কষ্ট পাই

ডা. রাজিকুল ইসলাম রাজিব :
2023-05-23 19:06:32
শিশুদের অপচিকিৎসা দেখলে খুব কষ্ট পাই

হাসপাতালের শিশু ওয়ার্ড (ইনসেটে ডা. রাজিকুল ইসলাম রাজিব)

হাসপাতালের রুমে বসে রোগী দেখছি। আমার সামনের চেয়ারে একজন মহিলার কোলে দশ মাসের বাচ্চা বসা। পাশের চেয়ারে মহিলার স্বামী। কোলে বসা বাচ্চার অসুখ। অসুখের নাম ডায়রিয়া। গত তিন থেকে ডায়রিয়া। দিনরাতে দশ-এগারো বার পাতলা পায়খানা। কিন্ত কোন পানি শূণ্যতা নেই। বাচ্চা বেশ হাস্যজ্জ্বল। ডায়রিয়ার জন্য মোট সাতটি ঔষধ চলছে। তার মধ্যেই এন্টিবায়োটিক-ই তিনটি। তিন দফায় প্রেসক্রিপশন করেছে ঔষধের দোকানদার আর শিশু চিকিৎসক হিসাবে পরিচিত অ-ডাক্তার।

আমি অস্থির অভিভাবককে বললাম," ছোট বেলায় আপনাদের ডায়রিয়া হয়েছিল?" তাদের সরল উত্তর," হয়েছিল। " আমার প্রশ্ন," মা-বাবা আপনাদেরকে নিয়ে বিভিন্ন ডাক্তারের চেম্বারে দৌড়ঝাঁপ করেছিল? হাসপাতালে ভর্তি করেছিল?" তাদের উত্তর," সে সময় তো এত ডাক্তার ছিল না। স্যালাইন ছাড়া আর কোন চিকিৎসা ছিল না।" আমি বললাম," ঐটাই আসল চিকিৎসা। শুধু খাবার স্যালাইন। আর বমি না থাকলে জিংক সিরাপ। সাথে স্বাভাবিক খাবার। বাড়তি কলা, ভাতের মাড়, চিড়ার পানি আর সম্ভব হলে ডাবের পানি দিতে পারেন। ভাইরাস জনিত ডায়রিয়া।সাতদিনে এমনিতেই ভাল হয়ে যাবে। কিছু ডায়রিয়াতে এন্টিবায়োটিক দিতে হয়। কিন্ত আপনার বাচ্চার এই ডায়রিয়ার জন্য কোন এন্টিবায়োটিক লাগবে না। " আমি আরও একটু যোগ করে বললাম," আসলে আপনাদের বাচ্চা অসুস্থ না। অসুস্থ আপনারা। অসুখের নাম- অস্থিরতা।"

জেলা সদর আর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের শিশু বিভাগেরও একই অবস্থা। ওয়ার্ডের ভিতরে , ওয়ার্ডের বাইরের বারান্দায় অনেক ডায়রিয়ার বাচ্চা ভর্তি থাকে। যাদের বেশিরভাগেরই ভর্তির কোন প্রয়োজন নেই। যাদের কোন পানি শূণ্যতা নেই। পায়ের উপর পা তুলে দিয়ে খুব সুন্দর ভাবে বাড়িতে চিকিৎসা সম্ভব ছিল। কিন্ত দূর দুরান্ত থেকে অপ্রয়োজনে অনেক অভিভাবক বাচ্চার ডায়রিয়ার জন্য বড় বড় হাসপাতালের দিকে দৌড় দেয়। অনেক ওভার স্মার্ট অভিভাবক উপজেলা সদরের মেডিকেল অফিসারের সাথে উচ্চবাক্য করে উন্নত চিকিৎসার জন্য মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করায়। হাসপাতালে এসেও অনেকে ইন্টার্ণ আর মিড লেভেল ডাক্তারের সাথে চড়া গলায় বাক্যলাপ করে। তাদের একটাই কথা, ম্যাজিক দেখান। বাচ্চার পায়খানা বন্ধ করে দেন।

আমরা এ ধরনের অস্থির আর অবুঝ অভিভাবকদের ডায়রিয়া সম্পর্কে অনেক ওয়াজ-নসিয়ত করি। কেউ বোঝে, আবার কেউ অবুঝ থাকে। অবুঝেরা বলে এমন একটা ঔষধ দেন যাতে একেবারে কেল্লা ফতে হয়ে যায়। আমরা বলি, ডায়রিয়ার জন্য একেবারে কেল্লা ফতে হয়ে যাওয়ার মত কোন ঔষধ বিশ্বে এখনও আবিষ্কার হয় নি। দেশে- বিদেশে ডায়রিয়ার চিকিৎসা একই।

বর্তমানে অনেকে রোগ সম্পর্কে বিশেষজ্ঞ হয়েছে। কেউ জার্নাল পড়ে, কেউ ইউটিউব দেখে। কেউ আবার ডাক্তার হয়েছে মেডিকেলে না পড়ে, কেউ ঔষধের দোকানে ঔষধ বিক্রি করতে করতে, কেউ ডাক্তারের চেম্বারে রোগীর সিরিয়াল দিতে দিতে, আরও অনেক কিছু করে। এই জগাখিচুড়ীর প্যাঁচে পড়ে অনেক রোগীর অভিভাবক বিভ্রান্ত হচ্ছে। অনেকের অস্থিরতা বাড়ছে।

আপনি যেমন সমাজের অন্যায় দেখলে মানসিক ভাবে দগ্ধ হন, কষ্ট পান। আমিও তেমনি শিশুদের অপ চিকিৎসা দেখলে খুব কষ্ট পাই। শিশুদের উপর মুড়ি-মুড়কির মত অপ্রয়োজনীয় এন্টিবায়োটিকের প্রয়োগ দেখলে কষ্ট পাই। আমার সামনে একটা অসুস্থ বাচ্চা আসলে প্রথমেই চিন্তা করি, " এই বাচ্চার জায়গায় যদি আমার নিজের বাচ্চা থাকত তাহলে কি চিকিৎসা দিতাম, কি টেস্ট করতে দিতাম।"

(আশা করি এমবিবিএস/বিডিএস ডাক্তারদেরকে নিয়ে কেউ কোন মন্তব্য করবেন না।)

লেখক :

ডা. রাজিকুল ইসলাম রাজিব


জুনিয়র কনসালট্যান্ট, পেডিয়াট্রিক্স


উপজেলা হেলথ কমপ্লেক্স, পত্নীতলা, নওগাঁ।


আরও দেখুন: