এইসব কথা বলা বেশ সহজ

ডা. রাজিকুল ইসলাম রাজিব :
2023-05-15 10:05:30
এইসব কথা বলা বেশ সহজ

এইসব কথা বলা বেশ সহজ (ইনসেটে লেখক)

আমার পরিচিত একজন। বয়স পঞ্চান্ন। হেলথ সেক্টরে চাকুরী করেন। তবে ডাক্তার নন। বাড়ি থেকে তার কর্মস্থলের দূরত্ব চল্লিশ কিলোমিটার। প্রতিদিন চল্লিশ চল্লিশ মোট আশি কিলোমিটার বাসে জার্নি করেন। সন্ধ্যায় বাড়ি ফিরে একটু ফ্রেশ হয়ে দশ কিলোমিটার মোটরসাইকেল চালিয়ে তার বাবাকে দেখতে গ্রামের বাড়ি চলে যান। তার বাবার বয়স পঁচাশি, অসুস্থ, দীর্ঘদিন শয্যাশায়ী ও অর্ধ চেতন। বাড়িতে দুই ছেলে থাকা সত্ত্বেও বড় ছেলে প্রতিদিনের অফিস আর দীর্ঘ ভ্রমণের ক্লান্তি শেষে মোটরসাইকেল চালিয়ে অসুস্থ বাবাকে দেখতে যান। প্রায় ঘন্টা খানেক বাবার পাশে বসে থাকেন, বাবার শরীর স্পর্শ করেন। এটা তার প্রতিদিনের রুটিন। সেদিন তার মোটরসাইকেলের পিছনে চেপে তার বাবাকে দেখতে গেলাম, চিকিৎসা দিলাম। বৃদ্ধ বাবার যত্নের কোন কমতি দেখলাম না। চোখ জুড়ানো দৃশ্য।

পরিচিত আর একজন বয়সী মানুষ। বয়স পঁচাশি বছর। তিনি একটি বেসরকারী হাসপাতালের ICU-তে ভর্তি আছেন। গত পাঁচ দিন যাবত জ্ঞান নেই। লাইফ সাপোর্টে আছেন। একেবারে জীবন মৃত্যুর সন্ধিক্ষণে। বাবাকে ICU- তে ভর্তি রেখে তার ছেলেমেয়েরা ঐ হাসপাতালের একটি কেবিনে থাকছে। তারা তাদের বাবার জন্য নিরন্তর চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। প্রতিদিন এতএত খরচ। কিন্ত খরচের প্রতি তাদের কোন-ই ভ্রুক্ষেপ নেই। অনেক ধনবান বা শিক্ষিত ছেলেমেয়েরাও "রাখে আল্লাহ, মারে কে " এই বলে এ অবস্থায় বাবাকে নিয়ে বাড়ির পথে হাঁটা দিত। কিন্ত এই ছেলেমেয়েরা তাদের সর্বোচ্চ চেষ্টা করছে। এতগুলো সুন্দর মানসিকতার ছেলেমেয়েকে একসাথে দেখে যে কারও মন জুড়িয়ে যাবে।

আমার পরিচিত একজন স্যার (ডাক্তার)। যার নামের পরে দুইটি বড়সড় ডিগ্রি। একটি বিভাগীয় শহরের মেডিকেল কলেজের প্রফেসর। ইচ্ছা করলেই বিভাগীয় বা জেলা শহরে প্র্যাকটিস করতে পারতেন। চেম্বারে অনেক রোগী দেখতে পারতেন। তা না করে তিনি তার নিজ উপজেলায় থাকেন আবার সেখানেই চেম্বার করেন। আমি একদিন বিস্ময় নিয়ে তাকে জিজ্ঞেস করলাম," স্যার আপনি এই ডিগ্রি আর পদ নিয়ে উপজেলা সদরে থাকেন কেন? ইচ্ছা করলেই তো বিভাগীয় শহরে ব্যস্ত সময় কাটাতে পারতেন। " স্যার বললেন," আমার মা বৃদ্ধ। বাবা নেই। বাড়িতে আরও দুই ভাই আছে। মা আমাকে ছাড়া থাকতে পারেন না। মা আবার শহরে থাকতে পারেন না, অস্বস্তি লাগে। একারণে মাকে ছেড়ে আর বড় শহরে আসতে পারি নি।" স্যার কথাগুলো বলতে বলতে উদাস হয়ে গেলেন। আমি মাতৃভক্ত একটা উদাসী ছেলের মুখের দিকে তাকিয়ে থাকলাম।

মা-বাবাকে ভালবাসি। পৃথিবী এক দিকে আর মা-বাবা এক দিকে। এইসব কথা বলা বেশ সহজ। কিন্ত ধৈর্য্য ধরে তাদের সাথে ভাল ব্যবহার করা, আদবের সুরে কথা বলা, অন্য সকলের চাইতে তাদেরকে অগ্রাধিকার দেওয়া, তাদের জন্য হাত খুলে খরচ করা বেশ কঠিন। মুখে বলা বেশ সহজ কিন্ত বাস্তবে তা বেশ কঠিন।

আমি যদি মা-বাবার ভাল চাই, তাহলে সন্তান হিসাবে আমাকে খুব ভাল ও সৎ হতে হবে। মৃত্যুর পর কবরে শুয়ে তাঁরা কোন আমল করতে পারবেন না। সকল কল্যাণের পথ বন্ধ হয়ে যাবে। কিন্ত একজন সন্তান হিসাবে যদি আমি কোন সৎ কাজ করি তবে কবরে শুয়ে তাঁরা তার সুফল ভোগ করতে পারবেন। সন্তান হিসাবে মা-বাবার জন্য এর চেয়ে ভাল আর মূল্যবান গিফট আর হতে পারে না।

 

লেখক :

ডা. রাজিকুল ইসলাম রাজিব


জুনিয়র কনসালট্যান্ট, পেডিয়াট্রিক্স


উপজেলা হেলথ কমপ্লেক্স, পত্নীতলা, নওগাঁ।


আরও দেখুন: