ভাল ডাক্তার হতে চাইলে ৩টি গুণ লাগবে

অধ্যাপক ডা. কাজী দীন মোহাম্মদ :
2023-04-14 12:45:12
ভাল ডাক্তার হতে চাইলে ৩টি গুণ লাগবে

অধ্যাপক ডা. কাজী দীন মোহাম্মদ

সত্যি বলতে মেডিকেল সাইন্স পড়তে এসেছিলাম ইচ্ছার বিরুদ্ধে। ম্যাথম্যাটিকস এ খুব ভালো ছিলাম। মেট্রিকুলেশন আর ইন্টারমিডিয়েট দুটোতেই ১০০ তে ১০০ পেয়েছিলাম। নিজে বুয়েট এ ইঞ্জিনিয়ারিং পড়তে চাওয়া ছাড়া কিছু ভাবতাম না। কিন্তু স্কুলে আমার যে ক্লাস টিচার ছিলেন, স্যার কেন যেন আমাকে সবসময় ডা. দ্বীন মোহাম্মদ বলে ডাকতেন।

আমি মনে মনে ভাবতাম- আরে আমি তো ডাক্তার হবো না, কেন আমাকে স্যার শুধু শুধু ডাক্তার ডাকেন! বাবাও কমবেশি চাইতেন আমি যেন মেডিকেল পড়ি। তাই ঠিক করলাম- আচ্ছা আমি দিবো পরীক্ষা মেডিকেলে আর কেবল ঢাকা মেডিকেলেই দিবো। বুয়েট, ঢাকা মেডিকেল কলেজ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় সব জায়গাতেই টিকে গেলাম। ভাগ্যে আমাকে নিয়ে অন্য কিছ পরিকল্পনা করা ছিল হয়তো। শেষমেশ চলেই এলাম ঢাকা মেডিকেল কলেজে পড়তে।

অনিচ্ছায় আসলেও আগ্রহ জন্মাতে খুব সময় লাগেনি। এনাটমিতে বরাবরই খুব ভালো ছিলাম। ম্যাডাম আমাকে পাশে বসিয়ে বাকিদের কার্ড পরীক্ষা নিতেন। মাঝেমাঝে আমিও প্রশ্ন করতাম আমার বন্ধুদের। ক্যারাম খেলতে পছন্দ করতাম খুব। কখন যে খেলতে খেলতে সময় পেরিয়ে যেত বুঝতামও না। তবে পড়াশোনা আর রেজাল্ট ঠিক রেখে যত রকমের খেলাধুলা করা যেত সব করতাম।

আমাদের সময় ইন্টার্নশিপ করার পর গ্রামে যাওয়া বাধ্যতামূলক ছিলো। তবে সব প্রফেশনাল পরীক্ষা মিলিয়ে যাদের নাম্বার অনেক ভালো থাকতো, তাদের কিছুসংখ্যককে মেডিসিন, সার্জারি আর গাইনীতে রেখে দেয়া হতো। তো আমি মেডিসিন এ চান্স পেয়ে যাই।

মেডিসিনে ট্রেনিং শেষে আমার প্রথম পোস্টিং ছিল তৎকালীন IPGMR এ যা এখন BSMMU নামে পরিচিত। সেসময় PSC থেকে IPGMR এ নিউরোলজিতে দুইজন এসিস্ট্যান্ট প্রফেসর নেয়ার প্রক্রিয়া চলছিল। পরীক্ষা হবে নিয়োগের জন্য। যারা এপ্লাই করছিলেন তাদের মধ্যে আমি ছিলাম সবচেয়ে জুনিয়র। আমার চেয়ে ১০-১২ বছরের সিনিয়র এমনকি আমার কয়েকজন শিক্ষকও ছিলেন সে তালিকায়। ৬৬ জন থেকে ২ জন বাছাই হয়। আমি সেই দুইজনের একজন হয়ে যাই ভাগ্যচক্রে। এরপর থেকেই মূলত আমার নিউরোলজি নিয়ে পথচলা শুরু।

আমি বলবো যে, বাংলাদেশে নিউরোলজিতে আমার খুব কন্ট্রিবিউশন নেই, তবে যা আছে তা হলো ডেডিকেশন। আর সেই ডেডিকেশন এর কোন ঘাটতি ছিলোনা আমার পুরো ক্যারিয়ার জুড়ে। ২০০৩ সালে ঢাকা মেডিকেল কলেজ এর প্রফেসর থাকাকালীন ন্যাশনাল ইন্সটিটিউট অব নিউরোসাইন্স প্রতিষ্ঠায় হাত দেই। ২০১২ সাল নাগাদ প্রতিষ্ঠানটি পূর্ণাঙ্গ রূপ পায়। আমি সেখানে প্রতিষ্ঠাতা পরিচালক হিসেবে দায়িত্বপালন শুরু করি আর এখনো করছি। এর আগে ঢাকা মেডিকেল কলেজে প্রিন্সিপাল হিসেবেও কর্মরত ছিলাম। ১৯৯৪ সালে আমি সহ যেখানে মাত্র ৩ জন নিউরোলজিস্ট ছিলেন এদেশে, সেখানে এখন প্রায় ২০০ জন দক্ষ নিউরোলজিস্ট তৈরি করতে সক্ষম হয়েছি আমরা। এর পেছনে রয়েছে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে এ বিষয়ে পড়ার সুযোগ বৃদ্ধি।

আমি মনে করি একজন ভালো ডাক্তার হতে গেলে ৩ টা ব্যাপার অবশ্যই একজন মেডিকেল স্টুডেন্টকে ধারণ করতে হবে। প্রথমত, ভালো লেখাপড়া করতে হবে। তাকে প্রচণ্ড পড়ুয়া হতে হবে। দ্বিতীয়ত, তার মধ্যে সততা আর একাগ্রতা বা লেগে থাকার প্রবণতা থাকতে হবে। তৃতীয়ত, আত্মোৎসর্গের মনোভাব, ধৈর্য আর রোগীর প্রতি সহমর্মিতা থাকতে হবে। এগুলো না থাকলে ভালো একজন ডাক্তার হওয়া খুব কঠিন। তবে এই তিনটা বিষয়ের উর্ধ্বে আরেকটা ব্যাপারকে আমি খুব গুরুত্বপূর্ণ মনে করি। তা হলো ধর্মীয় অনুভূতি। এটা মানুষের প্রতি দায়িত্ববোধ বাড়ায়, দায়বদ্ধতা সৃষ্টি করে আর খারাপ কাজ থেকে দূরে রাখে। এই ধর্মীয় অনুভূতিটা সব কাজে খুব সুন্দর একটা মসৃণতা এনে দেয়।

তরুণ ডাক্তার আর মেডিকেল ছাত্রদের আমি সবসময় একটা কথাই বলি যে, তোমরা দেশের সেরা ছাত্র-ছাত্রীদের একটা গ্রুপ। তোমরা চাইলে অনেক কিছুই করতে পারো। যা প্রয়োজন তা হলো তোমার একাগ্রতা আর তোমার কোয়ালিটি যেটা তোমাকে অর্জন করতে হবে কষ্ট করে। তোমার যতই পিছুটান থাকুক না কেন কিংবা যতই সীমাবদ্ধতা থাকুক, দিনশেষে তোমার কোয়ালিটিই তোমাকে চেনাবে।

সৌজন্যে : হিউম্যান্স অফ ডিএমসি। 


আরও দেখুন: