সরকারি হাসপাতালে বেসরকারি বাণিজ্যিক চিকিৎসা সেবা: হিতে বিপরীত হতে পারে
ডা. বাহারুল আলম (সভাপতি, খুলনা বিএমএ)
দীর্ঘ জল্পনা-কল্পনার পর স্বাস্থ্যমন্ত্রী নিজকক্ষে ৩০-০৩-২০২৩ বৃহস্পতিবার নির্ধারিত ফী-র বিনিময়ে ইনিস্টিটিউশনাল বা বৈকালিক প্রাতিষ্ঠানিক চিকিৎসা সেবা কার্যক্রম পরীক্ষামূলক উদ্বোধন করেন।
“সরকারি হাসপাতালে বেসরকারি বাণিজ্যিক চিকিৎসা সেবা কার্যক্রমের ঐতিহাসিক যাত্রা শুরু হল”!
নাগরিকদের চিকিৎসা পাওয়ার সাংবিধানিক অধিকার রাষ্ট্র নিয়ন্ত্রিত সরকারি হাসপাতাল-সমূহে যতটুকু পাওয়ার সুযোগ ছিল তাও বিপর্যস্ত হওয়ার পথে – এ সিদ্ধান্তে চিকিৎসক ও সাধারণ রোগীদের বহুবিধ সংকট সৃষ্টি হবে।
ব্রিটিশ উপনিবেশের হাত ধরে বাংলাদেশে চিকিৎসা ব্যবস্থা যবে থেকে ভারতবর্ষে অনুপ্রবেশ করেছে তবে থেকে চিকিৎসকদের প্রাইভেট প্রাকটিস চালু হয়েছে। কিন্তু কখনও রাষ্ট্র নিয়ন্ত্রিত হাসপাতালে (সরকারি) চিকিৎসকদের প্রাইভেট প্রাকটিসের অনুমোদন ছিল না। কেউ করার চেষ্টা করলে সেটা অপরাধ হিসাবে চিহ্নিত হত। স্বাস্থ্যমন্ত্রী সেই দীর্ঘদিনের লালিত অপরাধকে বৈধতা দিল সরকারি হাসপাতালের বারান্দায়।
চিকিৎসকরা মূলত প্রজাতন্ত্রের কর্মচারী। মাসিক বেতনের ভিত্তিতে তারা রাষ্ট্রের পক্ষে নাগরিকদের চিকিৎসা দিয়ে থাকে ।রাষ্ট্রীয় প্রটোকলের ঘেরাটোপের মধ্যে থেকে মন্ত্রীর কল্পনাপ্রসূত এরূপ সিদ্ধান্ত বাস্তবায়িত হলে যে সকল দ্বান্দ্বিক অসঙ্গতি দেখা দিতে পারে তা নিচে উল্লেখ করা হল --
১) চিকিৎসকদের বৈকালিক অবসরে প্রাইভেট প্রাকটিস করা এবং চিকিৎসা ব্যবস্থা প্রাইভেটাইজেশন হওয়া এক কথা নয়- গুলিয়ে ফেলেছে।
২) চিকিৎসকরা আন্তর্জাতিক শ্রম আইন দ্বারা নির্ধারিত সপ্তাহে ৪০ ঘণ্টা শ্রম ও মেধা দিয়ে রোগী চিকিৎসা করে থাকে। দিনের অন্য সময় তারা বিশ্রাম, বিনোদন ও পারিবারিক কাজে সময় ব্যয় করে, শুক্রবারে সাপ্তাহিক ছুটি ভোগ করে। মন্ত্রীর এ আদেশে চিকিৎসকের সে অধিকার খর্ব কর হল।
৩) হাসপাতালে জরুরি চিকিৎসার প্রয়োজনে সপ্তাহে ৪০ ঘণ্টার বাইরে যেকোন দিন/ তাদেরকে ছুটে যেতে হয়। এরূপ সিদ্ধান্তের ফলে উল্লেখিত নিয়ম –রীতি বিপর্যস্ত হবে।
৪) বিশ্রাম, বিনোদন ও পরিবারের সদস্যদের সময় না দিয়ে অতিরিক্ত অর্থের প্রয়োজনে কিছু চিকিৎসক প্রাইভেট চেম্বারে প্রাকটিস করে- এটি তার একান্তই ব্যক্তি স্বাধীনতা/ঐ এলাকার জনগণের প্রতি দায়বদ্ধতা। প্রাইভেট প্রাকটিস করতেও পারে, না-ও পারে। (বেসিক সাইন্সের অনেক চিকিৎসক প্রাইভেট প্রাকটিস করে না)। মন্ত্রীর আদেশ চিকিৎসকদের ব্যক্তিস্বাধীনতা খর্ব করল। এ অধিকার মন্ত্রীর নাই।
৫) স্বাস্থ্যমন্ত্রীর বৈকালিক প্রাতিষ্ঠানিক চিকিৎসা কার্যক্রম চালু হওয়ায় হাসপাতালের চেম্বার প্রাইভেট চেম্বারে রূপান্তরিত হল! সেখানে রোগী ফী দিয়ে চিকিৎসকের পরামর্শ ও অপারেশন করাতে পারবে। অর্থাৎ সরকারি হাসপাতাল বিকাল ৩টা থেকে ৬টা পর্যন্ত হয়ে গেল প্রাইভেট/ বাণিজ্যিক হাসপাতাল !যে কোন ধরনের বাণিজ্যিকতা রাষ্ট্রায়ত্ত হাসপাতালের দায়বদ্ধতা ক্ষুণ্ণ করবে।
৬) চিকিৎসকের নির্দিষ্ট কর্মঘন্টার পরে কেবলমাত্র রোগীর জরুরি অবস্থাকালীন তাকে ডেকে পাঠানো ছাড়া কোনপ্রকার বাধ্য করার এখতিয়ার স্বাস্থ্যমন্ত্রীর আছে কি? এ আদেশে সংবিধানের কোন ধারা বা বিধিবিধানের উল্লেখ নাই। মন্ত্রীর একান্ত মনগড়া আদেশে স্বাস্থ্যব্যবস্থা চলবে?
৭) স্বাস্থ্যমন্ত্রীর এ আদেশ প্রত্যক্ষভাবে আইএলও কনভেনশন –এর লঙ্ঘন বা অস্বীকৃতি। জাতিসংঘের আন্তর্জাতিক শ্রম আদালত কখনও এই সিদ্ধান্ত মেনে নেবে না। এ আদেশের বিরুদ্ধে চিকিৎসকরা আন্তর্জাতিক শ্রম আদালতে অভিযোগ দাখিল করলে বাতিল হয়ে যাবে।
৮) মেডিকেল কলেজের সহকারী, সহযোগী ও অধ্যাপকদের দিয়ে স্বাস্থ্যমন্ত্রী আর কত কাজ করাতে চায়? কলেজের ছাত্র পড়ানো ও তাদের পরীক্ষা নেওয়া, মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে বহির্বিভাগে রোগী দেখা, ভর্তি রোগীদের চিকিৎসা দেওয়া, নিয়মিত অপারেশন করা এবং জরুরি যে কোন চিকিৎসা / অপারেশন-এ হাসপাতালে ছুটে আসা, অন্য মেডিকেল কলেজের পরীক্ষা নিতে যাওয়া। এরপরে আবার স্বাস্থ্যমন্ত্রীর খায়েশ চাপলো ‘বৈকালিক চিকিৎসা কেন্দ্র সরকারি হাসপাতালে’ সপ্তাহে ২দিন (৩টা হতে ৬টা)রোগী দেখতে হবে। এতগুলো কাজেরও জন্য অধ্যাপকরা সময় পাবে কোথায়- তাদের কি ব্যক্তিজীবন থাকবে না? স্বাস্থ্যমন্ত্রী কি তাদের পুরোই গোলামীর জিঞ্জিরে আবদ্ধ করতে চায়?
৯) রাষ্ট্রের দেওয়া বেতনের বাইরে যে অধ্যাপক মুদ্রাস্ফীতির চাপে জর্জরিত, সেটা সামাল দিতে ব্যক্তি জীবনের স্বাদ- আহ্লাদ বিসর্জন দিয়ে বিকাল হতে গভীর রাত পর্যন্ত প্রাইভেট প্রাকটিস করে। সে পথে স্বাস্থ্যমন্ত্রী কাঁটা বিছিয়ে দিল।
১০) হাসপাতালে বিদ্যমান ব্যবস্থাপনায় জন্য প্রয়োজনীয় অর্থ বরাদ্দ, অবকাঠামো, জনবল, প্রযুক্তি ও উপকরণের তীব্র অভাব। এ অবস্থায় বৈকালিক রোগী দেখা কার্যক্রম কিভাবে স্বাস্থ্যমন্ত্রী সুস্থ রাখবে?
১১) মাত্র ৩০০ টাকায় হাসপাতালে যেখানে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের মত নিতে পারবে, সে রোগী কেন দ্বিগুণ, তিনগুণ টাকায় প্রাইভেট পরামর্শ নিতে রাজি হবে? তখন হাসপাতালের এসকল বাণিজ্যিক চেম্বারে প্রচণ্ড ভিড় হবে। বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক যখন অধিক সময়ে অধিক রোগী দেখতে অপারগ হবে তখনই শারীরিকভাবে লাঞ্ছিত হবে। স্বাস্থ্যমন্ত্রী কি সে ‘মাইর’ ঠেকাতে আসবে? হাসপাতাল ভাংচুর ও স্বাভাবিক পরিবেশ বিনষ্ট হবে।নৈমিত্তিক এ ঘটনায় হাসপাতালের ভর্তি থাকা সাধারণ রোগীরা আতংকে থাকবে। স্বাস্থ্যমন্ত্রী তাদেরকে কি দিয়ে আশ্বস্ত করবে?
১২) রোগীদের রোগ নিরীক্ষার ব্যবস্থা সরকারি হাসপাতালে একেবারেই অপ্রতুল, টেকনোলজিস্ট, প্রযুক্তি ও জনবল নেই বললেই চলে। তারপর বৈকালিক বাণিজ্যিক প্রাইভেট রোগীদের রোগ নিরীক্ষার ব্যবস্থা কিভাবে হবে? স্বাস্থ্যমন্ত্রীর মস্তিষ্কে এ ভাবনা আছে কি? বাংলাদেশের সবপ্রান্তের হাসপাতাল মন্ত্রীর আশীর্বাদপুষ্ট মানিকগঞ্জের হাসপাতাল নয় যে – হাত বাড়ালেই সব পাবে।
১৩) সরকারি হাসপাতালে বৈকালিক প্রাইভেট প্রাকটিসের উল্লেখিত অব্যবস্থার ফলে বেসরকারি ডায়াগনস্টিক সেন্টারের দালালেরা হাসপাতালের বারান্দায় অবস্থান নেবে, রোগী ধরে টানাটানি শুরু করবে। এ ছাড়াও ঔষধ কোম্পানির লোকেরা চিকিৎসকদের ভিজিট করার জন্য হাসপাতালের একই জায়গায় ভিড় করবে, হাসপাতালের স্বাভাবিক পরিবেশ বিঘ্নিত হবে। ভিডিও ক্লিপে দেখলে মনে হবে মাছের বাজার- সে দৃশ্য দেখে স্বাস্থ্যমন্ত্রী কি লজ্জা পাবে?
১৪) ৩০০টাকা ফী দেওয়া রোগীর স্বজনদের দাপটে হাসপাতালের পরিবেশ হবে থরকম্প। সকালে ১০ টাকা টিকেটের বিনিময়ে নাগরিকরা যে চিকিৎসা প্রত্যাশা করবে, বৈকালিক ১৫০-৪০০ টাকার ফীর বিনিময়ে একই হাসপাতালে, একই ব্যবস্থাপনা, একই জনবল– পার্থক্য কেবল সময়ের সকাল ও বিকাল। দুই সময়ে দুই ধরণের রোগীদের সাথে একই হাসপাতাল ভিন্নভিন্ন আচরণ করবে কিভাবে? তখনই বঞ্চিতরা ক্ষুব্ধ হয়ে মাইর ও ভাংচুর শুরু করবে। স্বাস্থ্যমন্ত্রীকে তখন কোথায় পাওয়া যাবে?
১৫) মেডিকেল গ্রাজুয়েট-রা জেনারেল প্রাকটিস (জিপি) করে যে ফী-র বিনিময়ে রোগী দেখত, সেই সমপরিমাণ বা তারচেয়ে কম টাকা দিয়ে বিকালে হাসপাতালে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক দেখাতে পারবে – এ কারণে জেনারেল প্রাক্টিশনারসদের প্রাকটিস বন্ধ হওয়ার উপক্রম হবে। যা চিকিৎসক বেকারত্বকে আরও প্রকট করে তুলবে।
১৬) রাষ্ট্র যেহেতু সকল চিকিৎসককে নিয়োগ দিতে পারছে না, তাদের কর্মসংস্থান হচ্ছে না। জেনারেল প্রাকটিস করে তারা জীবিকা নির্বাহ করে। স্বাস্থ্যমন্ত্রীর এ বিলাসী সিদ্ধান্তে তাদের আয়ের একমাত্র পথও বন্ধ হয়ে যাবে। অথচ স্বাস্থ্যমন্ত্রী তার এ সব বিলাসী সিদ্ধান্তে না গিয়ে রাষ্ট্র নিয়ন্ত্রিত জেনারেল প্রাকটিস বা জিপি চালু করলে চিকিৎসক বেকারত্ব একেবারেই দূর হত। প্রান্তিকের সাধারণ মানুষ মানসম্মত চিকিৎসা পেত।
এ ঘোষণার পূর্বাহ্ণে রাষ্ট্রের স্বাস্থ্যব্যবস্থার অভিভাবক স্বাস্থ্যমন্ত্রী উল্লেখিত সংকটের বিষয়ে কোন কিছু না ভেবেই মাঠ পর্যায়ের চিকিৎসকদের সাথে কোন পরামর্শ না করে আমলাদের একচ্ছত্র পরামর্শ ও প্ররোচনায় এরূপ কল্পিত ও অবাস্তব সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছে।
সরকারি হাসপাতালে প্রাইভেট চেম্বার না করে সারা বাংলাদেশে জিপি-দের জন্য রাষ্ট্র নিয়ন্ত্রিত প্রাইভেট চেম্বার খুলে দিলে রোগীরা মানসম্মত চিকিৎসা পেত ও চিকিৎসক বেকারত্ব দূর হত।
এরপরেও কি চিকিৎসকরা চুপ করে থাকবে? চিকিৎসকদের কথা বলা ও প্রতিবাদ করা প্রয়োজন।