কে কাকে স্যার ডাকবে?

ডা. রাজিকুল ইসলাম রাজিব :
2023-03-26 10:00:03
কে কাকে স্যার ডাকবে?

ডা. রাজিকুল ইসলাম রাজিব, জুনিয়র কনসালট্যান্ট, পেডিয়াট্রিক্স

কে কাকে স্যার ডাকবে ? কে প্রভু আর কে গোলাম? কে সন্মানে বড় আর কে সন্মানে ছোট? আর এই সম্মানের মাপকাঠি-ই বা কি? বর্তমান সামাজিক প্রেক্ষাপটে এর উত্তর দেওয়া আসলেই বেশ কঠিন। তবে এর সমাধান নিজের বিবেকের কাছে।

ক্যাডার (বিসিএস) সার্ভিসে "স্যার" শব্দটির প্রচলন একটু বেশি। তারা নিজেদের মধ্যে সম্বোধনের ক্ষেত্রে এই শব্দটি বেশি ব্যবহার করে থাকে। সাধারণত জুনিয়ররা সিনিয়রদের "স্যার" বলে সম্বোধন করে। আন্তঃ ক্যাডারদের মধ্যে সম্বোধনের ক্ষেত্রেও এই শব্দটি বেশ ব্যবহার করা হয়। এক ক্যাডারের জুনিয়র অন্য ক্যাডারের সিনিয়রকে "স্যার" বলে সম্বোধন করে। অবশ্য সবাই করে না। তবে যারা করতে পারে তারা তুলনামূলক বেশি স্মার্ট ও ভদ্র।

ক্যাডার সার্ভিস বাদেও "স্যার" শব্দটি স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়, অফিস-আদালতে ব্যবহৃত হয়। একজন জুনিয়র শিক্ষক সিনিয়র শিক্ষককে "স্যার" বলেন। ব্যাংকের জুনিয়র কর্মকর্তা সিনিয়র কর্মকর্তাকে "স্যার" বলেন। বেসরকারী কিছু অফিসে "বস" শব্দের প্রচলন আছে। একটু ইসলাম জানা ও মানা মানুষকে ডাকা হয় হুজুর , যার ইংরেজি অর্থ স্যার। বাসের হেলপার বাসের ড্রাইভারকে "ওস্তাদ" বলে। এরকম একটা কাঠামো থাকা মন্দ নয়। এতে চেইন অফ কমান্ড মেইনটেন হয়। অফিসের নিচের পদের কোন কর্মচারী উপরের পদের কাউকে ভাই-বাবা বা কোন সম্বোধন ব্যতীতই কথাবার্তা বললে কর্মস্থলের শৃঙ্খলা নষ্ট হবে।

আমি ব্যক্তিগত ভাবে কাউকে "স্যার" বলতে কখনও কুণ্ঠাবোধ করি না। বিশেষ করে শিক্ষকদের ক্ষেত্রে কখনও নয়। নিজের শিক্ষক ব্যতীত সিনিয়র শিক্ষক যারা আমার শিক্ষক ছিলেন না তাদের "স্যার" বলি। আমার প্রফেশনের সিনিয়রদের "স্যার" বলে সম্বোধন করি। অন্য ক্যাডারের আমার চেয়ে সিনিয়র কাউকেও
"স্যার" ডাকি।

তবে এই "স্যার" শব্দটি সাধারণ মানুষের কাছ থেকে শুনতে চাওয়ার অভিপ্রায়টি মোটেও ঠিক নয়। সাধারণ মানুষ অফিসিয়াল ডেকোরাম বোঝে না। কে স্যার আর কে সাহেব এসব তাদের মাথায় খেলে না। সাধারণ মানুষ "স্যার" বলতে বোঝে শুধুই পুলিশ আর প্রশাসনের লোকদের। গ্রাম-শহরের রাজনীতিবিদ আর সাংবাদিকদেরও একই অবস্থা। ধরুন, একটি প্রোগ্রামে উপস্থিত আছেন UNO, UHFPO (THO), OC, AC Land আর কলেজের সহকারী অধ্যাপক। তারা ষষ্ঠ গ্রেডের UNO কে ডাকবে স্যার। একই গ্রেডের UHFPO আর কলেজের শিক্ষককে বলবে ভাই। আর নবম গ্রেডের AC Land কে বলবে স্যার। নবম গ্রেডের নন ক্যাডার গেজেটেড OC কেও বলবে স্যার ।

সাধারণ মানুষ ক্ষমতাকে ভয় পায়। সাধারণ মানুষ শক্তিকে ভয় করে। তারা তাকেই স্যার বলে যাকে নিজেদের চেয়ে বেশি ক্ষমতাধর ও শক্তিশালী মনে করে। পদে, সন্মানে বা জ্ঞানে ভারী এমন লোককে স্যার বলে না। আর যারা উঠতে-বসতে স্যার শব্দটি শুনে অভ্যস্ত তারা ভাই, সাহেব, সোনা, জাদু এই টাইপের শব্দ শুনে অস্বস্তিতে পড়ে যায়। অনেক সময় তারা খারাপ প্রতিক্রিয়া দেখান।

আপনার নিজের জন্য "স্যার" শব্দটি শুনতে যদি বেশ ভাল লাগে। ভাই বা অন্য শব্দ শুনলে যদি আপনার গায়ে ছ্যাঁকা লাগে তবে বুঝতে হবে আপনি অহংকারীদের কাতারে শামিল হয়েছেন। নিজেকে উঁচু তলার মানুষ ভাবছেন, আর অন্যরা নিঁচু। এক্ষেত্রে আশু আত্মসংশোধনের প্রয়োজন।

ব্যক্তিগত ভাবে আমার কাছে " স্যার " শব্দটি বেশ হালকা। আমি সবাইকেই স্যার ডাকতে পারি। আমার আত্মসম্মানে  লাগে না। কারণ সর্বদায় মানুষের অসহায়ত্ব আমার চোখে ভাসে। আমি সব মানুষের অসহায় অবস্থার সাক্ষী। কঠিন বিপদ, কঠিন অসুখের সময় মানুষ আমার কাছে আসে। তখন কারও মধ্যেই "স্যার" ভাবটি থাকে না। জীবন আর মরণ-ই তখন মুখ্য হয়ে ওঠে। এ কারণে "স্যার" শব্দটি আমার কাছে বেশ ঠুনকো।

কাকে "স্যার" ডাকলাম বা না ডাকলাম সেটা মুখ্য কোন বিষয় নয়। মুখ্য বিষয় হল অন্যজনকে প্রাপ্য প্রকৃত সম্মান দিলাম কিনা, ভাল ব্যবহার করলাম কিনা। তবে অন্যকে সঠিক সম্বোধন করতে পারাটাও স্মার্টনেসের অংশ। কেউ আপনাকে সম্মান দিলে আপনার উচিত তাকে আরও বেশি সম্মান করা ও তার সাথে ভাল ব্যবহার করা।অন্যকে সম্মান দিলে নিজের সম্মান কমে না, বরং বাড়ে।

(স্যার অর্থ জনাব, মহাশয়, হুজুর। আশা করি কেউ কোন পেশাকে উল্লেখ করে মন্তব্য করবেন না।)

 

লেখক : ডা. রাজিকুল ইসলাম রাজিব

জুনিয়র কনসালট্যান্ট, পেডিয়াট্রিক্স

উপজেলা হেলথ কমপ্লেক্স, পত্নীতলা, নওগাঁ। 


আরও দেখুন: