ক্যান্সার চিকিৎসক ও বিজ্ঞানী, যুক্তরাষ্ট্র

ডা. হামীম ইবনে কাওছার :
2023-03-08 13:20:28
ক্যান্সার চিকিৎসক ও বিজ্ঞানী, যুক্তরাষ্ট্র

ডা. হামীম ইবনে কাওছার, যুক্করাষ্ট্র প্রবাসী বাংলাদেশি চিকিৎসক

(১)

আমি দেশে গেলে সেই দুই সপ্তাহে আমার রুগীদের অন্য ডাক্তার/নার্স প্রাক্টিশনার-র দেখেছেন। আজ আমি রুগী দেখতে ঢুকলেই আমার রুগীরা আমাকে অভ্যর্থনা জানাচ্ছেন "ওয়েলকাম হোম" বলে! আমি তাদের বললাম, আমার হোম বাগেরহাটে, যেখানে আমার প্রাণ থাকে। তোমাদের এখানে আমার দেহ থাকে।
এক রুগে হেসে দিয়ে বললেন, তাহলে এখানে তোমার "ফিজিক্যাল হোম" বাগেরহাটে তোমার "মেন্টাল হোম"! মাত্র দুই সপ্তাহ ছিলাম না, তারা আমাকে কতটা মিস করেছেন, তার ফিরিস্তি দিচ্ছেন। তারা আশ্বস্ত যে আমি তাদের কাছে ফিরে এসেছি। তারা জানেন আমি বাংলাদেশে গিয়েছিলাম, বাগেরহাটে গিয়েছিলাম। তারা আমার মা কেমন আছেন, তা জানতে চাচ্ছেন। এই সব রুগীই ক্যান্সারের রুগী। তারা তাদের জীবনের সমস্যার কথা বাদ দিয়ে আমার মা কেমন আছেন, তা জানতে চাইছেন!

(২)

আমার এক রুগী, যার বয়স একাশি বছর এবং মেটাস্টাটিক ম্যালিগন্যান্ট মেলানোমা আছে। তিনি গত এক বছর ধরে ইম্যুনোথেরাপি পাচ্ছেন, খুব ভালো ফল দিয়েছে তার। তিনি প্রতি ভিজিট আমাকে প্রকাশ্যেই বলেন যে তিনি সৃষ্টিকর্তার পরে আমার উপর সবচেয়ে বেশি আস্থা রাখেন। আমার অনুপস্থিতিতে তার একটি পজিট্রন এমিশন টমোগ্রাফি করা হয়েছিল, তাতে দেখা গিয়েছে যে তার মেলানোমা শরীরের অন্যান্য জায়গায় ছড়িয়ে পড়েছে, কিন্তু তাকে সেই বিষয়টি পরিষ্কার করে কেউ বলে নি। তাকে বলেছে বর্তমান চিকিৎসা চালিয়ে যেতে। আমি আজ তাকে পুরো বিষয়টি ব্যাখ্যা করে বলেছি যে তার অসুখ ছড়িয়ে পড়ছে। আমি তাকে বিভিন্ন অপশনের কথা বললাম। কি কি চিকিৎসা তিনি পেতে পারেন, তাতে কেমন ফল পেতে পারেন তা বললাম। চিকিৎসা বন্ধ করে দিলে তিনি সম্ভাব্য কি ভাবে মারা যেতে পারেন তা বললাম। আমেরিকার অন্য কোনো বৃহত্তর ক্যান্সার সেন্টারে তিনি চিকিৎসা বা মতামতের জন্য যেতে চাইলে আমি তার আয়োজন করে দেব, সেটাও বললাম। আমি তাকে বললাম, তার আজই সিদ্ধান্ত নিতে হবে না। তিন সপ্তাহ তিনি চিন্তা করুন, পরিবার-পরিজনের সাথে আলাপ-আলোচনা করুন, তারপর আমরা আগামী ভিজিট- এই নিয়ে বিস্তারিত আলাপ করবো। আমি সবকিছু একটি সাদা কাগজে লিখে দিলাম, যাতে তিনি বাসায় যেয়ে ভুলে না যান আমি কি কি অপশনের কথা তাকে বলেছি।

(৩)

আমি তাকিয়ে দেখি তার চোখ থেকে নিঃশব্দে অশ্রুধারা বইছে। তার আটাশ বছরের বিবাহিত স্ত্রী, বাহাত্তর বছর বয়সী সারাহ, তার হাত শক্ত করে ধরে আছেন। আমি টিস্যুর বক্স এগিয়ে দিয়ে জিজ্ঞেস করলাম তিনি কেন কাঁদছেন? তিনি বললেন যে তার আপনজন বলতে কেউ নেই। তার আগের বিবাহ থেকে তিন সন্তান- দুই ছেলে এবং এক মেয়ে, তাদের বয়স পঞ্চাশের উর্দ্ধে এবং আমেরিকার অন্যান্য জায়গায় তারা থাকেন। তারা জানেন যে উনার মেটাস্টাটিক মেলানোমা আছে, এবং তিনি চিকিৎসা পাচ্ছেন, কিন্তু তারা কেউ তার খোঁজ নেন না।

তিনি অবাক হয়ে গেলেন যে আমি কুড়ি হাজার মাইল পাড়ি দিয়ে আমার মা-কে দেখতে গিয়েছি আর উনার সন্তানেরা একটা ফোন করে উনার খোঁজ নেন না। তিনি উচ্চ:স্বরে কেঁদে উঠলেন। কথা জড়িয়ে যাচ্ছে। তিনি বললেন, আমি তো কিছু চাইনি, কিন্তু তারা তো আমার একটা খোঁজ ফোন করে নিতে পারতো। তুমি আমাকে বলেছো বাড়িতে যেয়ে আমার আপনজনের সাথে আলোচনা করতে। কিন্তু আমার তো কোনো আপন জন নেই! আমি তোমাকেই আমার আপনজন মনে করি! তুমি বলো, আমি কি করবো?

(৪)

আমি তাঁর কাঁধে হাত রাখলাম, যেভাবে রাখতাম উনি আমার বাবা হলে। আমি উনাকে আমার চোখের পানি দেখাতে পারবো না, কারণ আমাকে উনি সম্বল মনে করছেন। সম্বল কে শক্ত হতে হয়। আমি অশ্রুগোপন করে উনাকে আশ্বস্ত করলাম। উনার মাথা আমার ঘাড়ের উপর, ছোট বাচ্চাদের মত। সারাহ-র চোখ অশ্রুসিক্ত। দুই অশীতিপর বৃদ্ধ-বৃদ্ধা আমার দিকে তাকিয়ে আছেন, আমি তাদের কি বলি সে জন্য। আমি যে তাদের বড় আপনজন! স্রষ্টার পরেই তারা আমার কথার উপর তাদের জীবন-মৃত্যুর সিদ্ধান্ত নিবেন। আমি আমার মনের উপর অনেক ভার অনুভব করছি। আমি তাদের বললাম, তিন সপ্তাহ পরে ফিরে আসুন, আমি একটা চূড়ান্ত পরামর্শ নিয়ে আসব তাদের জন্য।

(৫)

আমি আমার লাঞ্চের পুরো সময়টা ব্যয় করেছি তাদের সাথে, লাঞ্চ খাওয়া হয় নি। তারা আমাকে বিদায়ী আলিঙ্গন করছেন। করে বলছেন, আমরা তোমার এবং তোমার মায়ের জন্য অনেক দোয়া করি। প্রতিদিন করি। অত্যন্ত শক্ত ভাবে করি। তুমি যে কয়দিন ছিলে না এখানে, আমরা তোমার জন্য দোয়া করেছি যাতে তুমি সুস্থভাবে আবার "বাড়ি"তে ফিরে আসো, তোমার মেয়েদের কাছে। আমরা খ্রিস্টান, কিন্তু আমাদের ধারণা তোমার আল্লাহ আমাদের প্রার্থনা তোমার জন্য গ্রহণ করবে! আমাদের প্রার্থনা তোমার মায়ের জন্যও গ্রহণ করবে।

আমি প্রায়ই ভাবি, আমি যদি ডাক্তার না হতাম, তাহলে আমার বেঁচে থাকাই আমার কাছে মূল্যহীন মনে হতো। আমি টাকার জন্য ডাক্তারি পড়ি নি, আমি টাকার জন্য ডাক্তারি করি না। আমি পদ-পদবি-স্বীকৃতি পাবার জন্য ডাক্তারি করি না। আমি ডাক্তারি করি এই জন্য যে একজন মানুষ তার নিজের সন্তানের চেয়েও আমাকে বেশি আপন মনে করবেন, আমার উপর বেশি আস্থা পাবেন এবং চাইলে আমাকে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে পারবেন। আমি এজন্য ডাক্তারি করি যাতে আমার রুগীরা আমার নিরাপদে "বাড়ি"তে ফিরে আসার জন্য তাদের স্রষ্টার কাছে প্রার্থনা করবেন। তারা আমার মা, আমার মেয়েদের জন্য দোয়া করবেন। শুধু ডাক্তারি করি বলেই আমার নিজেকে একজন মানুষ মনে হয়। অন্য কোনো কিছুতেই আমার নিজেকে মানুষ মনে হতো না!


আরও দেখুন: