ডায়াবেটিস সচেতনতার পরিস্থিতি

ডা. এজাজ বারী চৌধুরী
2023-02-28 10:54:37
ডায়াবেটিস সচেতনতার পরিস্থিতি

ডা. এজাজ বারী চৌধুরী, ডায়াবেটিস বিশেষজ্ঞ

ডায়াবেটিস রোগিদের প্রথম ডায়াবেটিস ধরা পড়ার গল্প, প্রথম চিকিৎসার গল্প, বিভিন্ন ধরণের চিকিৎসা গ্রহনের গল্প, ভুল চিকিৎসার খেসারত দেবার গল্প ইত্যাদি শুনতে শুনতে ভাবি, অন্তত তিন ধরনের পরিস্থিতির সচেতনতা অত্যন্ত দরকার৷


॥ ১ ॥
২৪ বছর বয়সে ডায়াবেটিস ধরা পড়েছিলো মেয়েটির৷ অনেক টেষ্ট করেও যখন অসুস্থতার কারণ জানা যাচ্ছিলো না, তখন তার বাবা বললেন, আমার আর তোমার মায়ের দুজনেরই যেহেতু ডায়াবেটিস, তখন একবার তোমার সুগার টেষ্ট করে দেখিতো মা৷ তার বাবার হাতেই মেয়ের রোগ ধরা পড়লো এবং প্রথমবারেই সুগার পাওয়া গেলো ২৯৷ 


বুঝতে পারলাম, ডায়াবেটিসের লক্ষণগুলোর কোনটাই হয়তো মেয়েটির তখন ছিলোনা এবং বয়স কম বলে তার তৎকালীন চিকিৎসক ডায়াবেটিসের পরীক্ষা করাননি৷ বাবার বিচক্ষণতা নিয়ে মেয়ের গর্ব উপভোগ করলাম৷ কিন্তু তার প্রথম চিকিৎসার গল্পটা ছিলো আরো বিস্ময়কর৷ 


কোন ডাক্তার না দেখিয়ে, এক ফার্মেসিওয়ালা কাকুর দেয়া ঔষধে মেয়েটির চিকিৎসা শুরু করেন তার বাবা৷ অজ্ঞতাপ্রসূত সেই চিকিৎসায় প্রথম কদিনে মেয়েটির সুগার কমলেও সে আরো বেশী অসুস্হ হয়ে পড়ে৷ অবশেষে তাকে ডায়াবেটিস বিশেষজ্ঞের কাছে নিয়ে চিকিৎসা করানো হয়৷ 


এই মেয়েটির গল্পের শিক্ষনীয় দিকগুলো হচ্ছেঃ


১) লক্ষণ থাকলেই কেবল ডায়াবেটিস পরীক্ষা করতে হয়, কম বয়সে ডায়াবেটিস হয়না এসব ধারণা কিন্তু অনেক আগেই ভুল প্রমানিত হয়েছে৷ এছাড়া রোগির হিস্ট্রি নেবার সময় পারিবারিক রোগের প্রাদুর্ভাবগুলো না জানলে, অনেক রোগেরই ডায়াগনোসিস মিস হয়ে যেতে পারে৷ 


২) যেসব রোগ সারাজীবনের জন্য হয়, যেমন ডায়াবেটিস, প্রেশার ইত্যাদি, সেগুলোর চিকিৎসার শুরুটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ৷ প্রথম চিকিৎসা সঠিক না হলে বা ভুল হলে, সেটার খেসারত রোগিকে সারা জীবন ধরে দিয়ে যেতে হতে পারে৷ 


৩) অস্বাভাবিক কোন কিছুরই গড়পড়তা কারণ এবং সমাধান থাকেনা৷ ২৪ বছর বয়সী মেয়ে যার ডায়াবেটিসের লক্ষণ পর্যন্ত প্রকাশ পায়নি কিন্তু সে অতি উচ্চমাত্রার ডায়াবেটিসে ভুগছিলো, অস্বাভাবিক এই ক্ষেত্রে ডায়াবেটিসের প্রকৃত কারণ এবং ধরন বের করে সঠিকতম চিকিৎসা দেয়া কেবলমাত্র ডায়াবেটিস বিশেষজ্ঞের পক্ষেই সম্ভব ছিলো৷ 


এজাতীয় কেস পেলে অন্যান্য ডাক্তাররা পর্যন্ত যেখানে ডায়াবেটিস বিশেষজ্ঞের কাছে রোগিকে রেফার করেন, সেখানে মেয়েটির বাবা সামান্য ফার্মেসীওয়ালার চিকিৎসায় ভরসা রেখে নিজের অজান্তেই মেয়েটির ক্ষতি করে ফেলেছিলেন৷


॥ ২ ॥ 
কয়েক বছর আগে ফেসবুকে ক্ষতিকর কিটো ডায়েট দিয়ে ফ্রি ডায়াবেটিস চিকিৎসার প্রচলনকারী, পরবর্তিতে উচ্চদামে বাদাম, ভিনেগার, মধু, ঘি ইত্যাদি বিক্রেতা এবং বর্তমানে অতি উচ্চদামে হার্বাল ঔষধ বিক্রেতার কিছু কিছু রোগি মাঝে মধ্যেই পাই৷ 


কিটো ডায়েটের যুগের এক রোগির ভাষ্য ছিলো, কিসের ফ্রি চিকিৎসা? যাবার পর টেষ্ট করিয়েছে ১৬০০০/- টাকার বেশি, তাও সেগুলো বাইরে ভালো কোথাও করানো যাবেনা.... তার প্রতিষ্ঠান থেকেই করাতে হবে৷ প্রেসক্রিপশন দেখলাম, ৮ - ৯ পদের ফুড সাপ্লিমেন্ট যার কোন কোনটা কেবল তার চেম্বারেই পাওয়া যায়৷ আর তার দেয়া ডায়েট মেনে চলতে যেয়ে রোগি হয়েছে বিছানাগত৷ ডায়াবেটিস তো কমেইনি, বরং কিডনী বিকল হবার পথে৷


আরেকজন রোগি তার কথামতো ১২ কিমি হেঁটে হেঁটে হাঁটু ক্ষয় করে এখন তারই তৈরী কারকুমা জয়েন্ট গার্ড খেয়ে হাঁটু মেরামতের চেষ্টায় আছে৷ তবে এতো বেশি খরচের ধাক্কা সামলাতে না পেরে, বেচারা দিশেহারা৷ 


ফ্রি চিকিৎসার নামে শুরু হওয়া অপচিকিৎসা এবং অপব্যবসার শিকার মানুষগুলোর বোধোদয় ঘটছে অনেক কঠিন মাশুল দেবার বিনিময়ে৷ 


॥ ৩ ॥
প্রেগন্যান্সি ডায়াবেটিস হয়েছিলো ভদ্রমহিলার৷ চিকিৎসা করছিলেন তারই গাইনী ডাক্তার৷ এতো কম খাবার খেতে দিয়েছিলেন সেই মা কে, যেটা শুধু তাঁর প্রয়োজনীয় ক্যালরীর চেয়েও অনেক কম, তার মধ্যে বেড়ে ওঠা বাচ্চার কথা তো তিনি মাথায়ই আনেননি৷ ফলে গর্ভধারণের শেষ অংশে বাচ্চার অতিরিক্ত কম ওজনে ডাক্তার এবং রোগি দুজনেই আতঙ্কিত এবং বাধ্য হয়ে ডায়াবেটিসের ডাক্তারের শরণাপন্ন হওয়া৷ 


আরেক মা কে পেয়েছি, যার প্রেগন্যান্সি ডায়াবেটিসের চিকিৎসা চলছিলো এমন সব ঔষধ দিয়ে, যেগুলো গর্ভের বাচ্চার জন্য বিপদজনক হতে পারে এবং আমরা ডায়াবেটিস বিশেষজ্ঞরা কখনোই গর্ভকালীন সেসব ঔষধ দিই না৷ 


এক্ষেত্রে শিক্ষনীয় বিষয় হলো, গর্ভকালীন ডায়াবেটিস হবার কারণ সম্পূর্ণ ভিন্নধর্মি ও গর্ভধারণ সম্পর্কিত৷ এর চিকিৎসাও আলাদা, সুগার লেভেলের টার্গেটও আলাদা এবং ডায়েট প্ল্যানও হয় আলাদা৷ গর্ভকালীন বিভিন্ন স্টেজে খাবারের পরিমান এবং ক্যালরী বাড়াতে হয় যেন গর্ভের সন্তানের পুষ্টিতে কোন ঘাটতি না পড়ে৷ ইনসুলিন এই ডায়াবেটিসের নিরাপদ চিকিৎসা তবে ক্ষেত্রবিশেষে নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত দু একটি মুখে খাবার ঔষধ কখনো কখনো দেয়া যেতে পারে৷


॥ যন্ত্র সারার মন্ত্র॥


মানুষের দেহ একটি জটিলতম যন্ত্র যেটি মানুষের তৈরী যেকোন যন্ত্রের চেয়ে অনেক বেশি নিখুঁত এবং বিস্ময়কর৷ এই দেহযন্ত্রে যেকোন ত্রুটি হলে, দেহ প্রথমে নিজেই নিজেকে মেরামতের চেষ্টা করে আর ত্রুমাগত চেষ্টা করতে করতে যখন ব্যর্থ হয়, তখনই কেবল কোন রোগ আত্মপ্রকাশ করে৷


চিকিৎসাবিজ্ঞান এই দেহযন্ত্রের ত্রুটির মেকানিজমগুলো খুঁজে বের করা এবং তারপর সেগুলোর সঠিক মেরামত বা চিকিৎসার উপায় নিয়ে শত শত বছর ধরে গবেষণা করে যাচ্ছে৷ সুতরাং মনগড়া মতবাদ এবং ম্যাজিক ঔষধের উপর আস্থা রাখা হতে বিরত থাকুন৷ সর্বোপরি রোগ অনুযায়ী সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞের চিকিৎসা গ্রহন করুন৷ কারণ নির্দিষ্ট রোগের উপর অভিজ্ঞতা জ্ঞান এবং দক্ষতাই আপনার সঠিকতম চিকিৎসা নিশ্চিত করবে৷


ডা. মোঃ এজাজ বারী চৌধুরী৷
হেড অব ডায়াবেটিস সেন্টার,
মেডিনোভা মেডিক্যাল সার্ভিসেস ধানমন্ডি 
এবং
সিটি হাসপাতাল, লালমাটিয়া৷


আরও দেখুন: