মৃগী রোগঃ কুসংস্কার নয় সুচিকিৎসাই কাম্য
মমেক হাসপাতালে 'বিশ্ব মৃগী রোগ (ইপিলিপসি) দিবস' পালন করা হয়
প্রতি বছর ফেব্রুয়ারী মাসের দ্বিতীয় সোমবার 'বিশ্ব মৃগী রোগ (ইপিলিপসি) দিবস' পালন করা হয়। তাই এ বছরও জনসচেতনতা বৃদ্ধির লক্ষ্যে দিবসটি যথাযোগ্য মর্যাদায় পালিত হচ্ছে।
আমাদের সমাজে মৃগী রোগ সম্বন্ধে নানা ভুল ধারনা প্রচলিত রয়েছে। যেমন, এগুলো জ্বিন-ভুতের আছর কিংবা খারাপ হাওয়ার কারণে হয়। রোগীকে খিঁচুনির সময় 'জুতা শোঁকানো' 'আঘাত করা' 'গরুর হাড় বা লোহার শিক' ইত্যাদি মুখে চেপে ধরা হয়।
প্রকৃতপক্ষে, মৃগী রোগ মস্তিষ্কের একটি রোগ। একে চিকিৎসা বিজ্ঞানের পরিভাষায় 'Epilepsy' বলে।
আমাদের প্রতিটি কাজের জন্য মস্তিষ্ক থেকে একটি সংকেত আসে। এই সংকেত গুলোর অস্বাভাবিকতার জন্য মৃগী রোগের লক্ষণ প্রকাশিত হয়। এ রোগ যে কোনো বয়সে হতে পারে৷ এটা কোনো সংক্রামক রোগ নয়৷
মৃগী রোগের উপসর্গসমুহঃ
* মৃগী রোগীর শরীরের কোনো একটি অংশ অথবা সারা শরীরে একসঙ্গে কম্পন অনুভূত হয়ে ঝাঁকি দেয়। শরীরের নির্দিষ্ট কোন স্থানে খিঁচুনি হতে পারে আবার খিঁচুনি এক অঙ্গ থেকে বাড়তে বাড়তে সারা শরীরে ছড়িয়ে যেতে পারে।
* রোগী হঠাৎ করে অজ্ঞান হয়ে যেতে পারে৷ তবে রোগী অজ্ঞান হতেও পারে আবার নাও হতে পারে৷
* অনেকসময় রোগী মাটিতে পড়ে যায়। খিঁচুনীর সময় অনেকের জিহ্বা কেটে যেতে পারে কিংবা প্রস্রাব হয়ে যেতে পারে। মুখ দিয়ে ফেনা বের হতে পারে৷
* অনেক সময় শিশুদের ক্ষেত্রে আনমনা হয়ে যাওয়া বা ডাকলে সাড়া না দেওয়া এ ধরনের উপসর্গও প্রকাশিত হতে পারে।
* ঠিকমতো ঘুম না হলে, মানসিক চাপ বেশী থাকলে, জোরে শব্দ কিংবা আলোর ঝলকানিতে এসব রোগীর খিঁচুনি হয়ে যেতে পারে।
মৃগী রোগের কারণঃ
* প্রাইমারি ইপিলিপসি-
এগুলোর কোন কারণ খুজে পাওয়া যায় না। সাধারনত শিশুদের হয়।
* সেকেন্ডারি ইপিলিপসি-
এ প্রকার মৃগী রোগের একটি নির্দিষ্ট কারণ আছে। যে কারণের জন্য হচ্ছে, সেটি সংশোধন করার পর তার খিঁচুনি বন্ধ হয়ে যায় তাই এটি সাময়িক। মস্তিষ্কের টিউমার, স্ট্রোক ইত্যাদি প্রধান কারণ। সাধারনত ৪০ বা তার বেশি বয়সে এটি হয়।
পরীক্ষা নিরীক্ষাঃ
* মস্তিষ্কের ছবি তোলার বিভিন্ন উন্নত মানের ইমেজিং পদ্ধতি। যেমন—সিটি স্ক্যান, এমআরআই ইত্যাদি।
* শরীরের বিভিন্ন লবনসমুহ।
* ইলেকট্রো-এনকেফালোগ্রাম।
* চিকিৎসকগন প্রয়োজন সাপেক্ষে আরো বিভিন্ন ধরনের পরীক্ষা-নিরীক্ষা সম্পন্ন করাতে পারেন।
মৃগী রোগীর খিঁচুনির সময় প্রাথমিক ব্যবস্থাপনাঃ
* কাউকে খিঁচুনীতে আক্রান্ত হতে দেখলে-অহেতুক আতংকগ্রস্ত হবেন না। প্রচলিত কুসংস্কার যেমন, 'জুতা শোঁকানো' 'আঘাত করা' ইত্যাদি থেকে বিরত থাকুন। রোগীর হাত-পা চেপে ধরা বা মাথায় পানি দেয়ার প্রয়োজন নেই। মুখে ওষুধ বা কিছু খাওয়ানোর চেষ্টা করা ঠিক হবেনা। গরুর হাড় বা লোহার শিক ইত্যাদি মুখে চেপে ধরা ইত্যাদি সম্পুর্ন অবৈজ্ঞানিক।
* রোগীর নিকট থেকে বিপদজনক বস্তু যেমন, আগুন, পানি, ধারালো বস্তু ইত্যাদি সরিয়ে আনুন।
* রোগী দাঁড়ানো বা বসা অবস্থায় খিঁচুনীতে আক্রান্ত হলে তাকে আলতো করে ধরে শুইয়ে দিন অথবা এমন ব্যবস্থা নিন যাতে রোগী পড়ে গিয়ে মাথায় আঘাত না পায়। রোগীর মাথার নিচে বালিশ বা নরম কিছু দিন।
* খিঁচুনী স্বাভাবিকভাবে শেষ হতে দিন। খিঁচুনী বন্ধ করার জন্য রোগীকে চেপে ধরবেন না বা প্রতিরোধ করবেননা।
* রোগীর মুখে জোর করে আঙুল বা অন্য কিছু ঢোকানোর চেষ্টা করবেন না।
* রোগীর নাড়ীর স্পন্দন অনুভব করুন, রোগী ঠিকমতো শ্বাস নিতে পারছে কি না সেদিকে দৃষ্টি রাখুন। শ্বাস-প্রশ্বাস ব্যাহত হয় এমন কোন কিছু মুখে বা নাকে থাকলে তা সরিয়ে দিন।
* রোগীর গলায় টাই বাধা থাকলে বা বেল্ট পড়া থাকলে তা খুলে দিন। জামাকাপড় ঢিলে করে দিন। রোগীর আশেপাশে ভীড় জমতে দেবেন না।
* খিঁচুনী শেষ হলে রোগীকে এক পাশে কাত করে শুইয়ে দিন।
* রোগীকে দ্রুত হাসপাতাল নেয়ার ব্যাবস্থা করুন অথবা নিউরোমেডিসিন বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের শরনাপন্ন হোন।
মৃগী রোগীর চিকিৎসাঃ
মৃগী রোগের সুচিকিৎসা গ্রহন জরুরী। বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের পরামর্শে ঠিকমত ঔষধ সেবন এবং অন্যান্য পরামর্শ মেনে চলতে হবে।
এই চিকিৎসা খুবই দীর্ঘমেয়াদি এবং চিকিৎসা শুরু করার অল্প সময়ের মধ্যে উপসর্গগুলো চলে যায় না বরং সেটি সময় সাপেক্ষ্য। সাধারনত চিকিৎসা শুরু করার পর যদি টানা তিন বছর কোনো উপসর্গ না হয়, তখন ধীরে ধীরে ওষুধের মাত্রা কমিয়ে কমিয়ে বন্ধ করা হয়।
ঔষধ সেবনের ক্ষেত্রে কিছু সতর্কতা অবলম্বন করতে হয়। নিয়মিত চিকিৎসকের ফলোআপে আসতে হয়। এসব ওষুধের সঙ্গে অন্যান্য ওষুধের কিছু পারস্পরিক প্রতিক্রিয়া রয়েছে। সেজন্য অন্যান্য ওষুধ সেবনে চিকিৎসকের পরামর্শ গ্রহন করতে হবে। মৃগী রোগের ওষুধগুলো খাওয়ার সময় সন্তান ধারন করতে চাইলে অবশ্যই চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে হবে।
ভাল থাকবেন, সুস্থ্য থাকবেন। এই কামনাই করছি।