কানাডার হেলথ কেয়ার সিস্টেম

ডা. ইমতিয়াজ মির্জা
2023-01-12 13:02:11
কানাডার হেলথ কেয়ার সিস্টেম

কানাডার হেলথ কেয়ার সিস্টেম

আজকে একটা খবর এসেছে কানাডার নোভা স্কসিয়াতে ৩৭ বয়সী তিন সন্তানের মা, পেট ব্যাথা নিয়ে স্থানীয় হাসপাতালের ইমার্জেন্সিতে ভর্তি হয়েছিলেন। সেখানে তাকে দ্রুত ট্রিয়াজে ছেড়ে দিলেও তাকে ওয়েটিং রুমে বসিয়ে রাখা হয় সাত ঘন্টা। শেষ পর্যন্ত না পেরে সে ফ্লোরে শুয়ে পড়লে, তার স্বামী কোলে করে তাকে নিয়ে যান জরুরী বিভাগে। সেখানে এক্সরে করতে করতে তার বিপি কমে আসে। এরপর আর তাকে বাঁচানো যায়নি।

কানাডার হেলথ কেয়ার নিয়ে নিজের কিছু পার্সোনাল অভিজ্ঞতা শেয়ার করা দরকারী মনে করছি।

আমি খুব বেশী অসুস্থ হই না, সাধারন ঠান্ডা কাশি ছাড়া ২০১৭ পর্যন্ত তেমন কিছুতে কাবু হতাম না। দাঁতের অপারেশন হবার কারণে ডাক্তার একটা ব্যাথানাশক অষুধ দেয় তার সাথে ফাস্ট ফুড খাবার কারণে জীবনে প্রথমবারের মতো গ্যাস্ট্রিকের সমস্যা দেখা যায়। এর আগে দু একবার এমন হলেও বমি করার সাথে সাথে এটা চলে যায়। সে রাতে ৪-৫ বার বমি করলেও সমস্যা যায় না। পিঠের ব্যাথা বাড়তেই থাকে। শেষমেষ না টিকতে পেরে হাসপাতালে যাই।
সেখানে ব্যাথায় কাতরাতে থাকলে ট্রিয়াজে মহিলা ধমকে উঠে, কি ব্যাপার এ্যাডাল্ট মানুষ হয়ে এমন কাতরাচ্ছো কেন? ভয়াবহ ব্যাথা নিয়ে কোকাতে থাকার কারণে মহিলাকে জবাব দেয়ার সুযোগ হয়নি আর।

এরপর রাত ৫টা বাজে ঢুকলেও চিকিৎসা পাই সকাল সাড়ে দশটায়।
ব্যাথানাশক ইঞ্জেকশন দেবার পর বাড়ী ফিরে আসি।

এরপরের ভয়ংকর অভিজ্ঞতাগুলো আমার মেয়েকে নিয়ে।

তারও একই রকম না খাওয়া থেকে পিঠ ব্যাথা সংক্রান্ত। ২০২০ এর ঘোর কভিডের সময়ে তাকে নিয়ে ৪-৫ বার হাসপাতালে ভর্তি হতে হয়েছে, হাসপাতালে থাকতে হয়েছে।

অন এ্যাভারেজ ৪-৫ ঘন্টা অপেক্ষা করতে হয়েছে। কোন কোন ক্ষেত্রে ব্যাথা সহ্য করতে না পেরে নার্সকে ডাকতে গিয়ে তারপর তাদের পাওয়া গেছে। এক নার্স এতো বদমাশ সে আমার মেয়ের স্যালাইনের সিরিঞ্জ খুলে নিতে এসে, তর্কাতর্কি শুরু করে আমার মেয়ের সাথে। এরপর রাগ করে লাথি মেরে বসে স্যালাইনের স্ট্যান্ডে। ভয়ংকর টাইপের বদমাশ।

বেশিরভাগ সময়ে হাসপাতাল থেকে বাড়ীতে পাঠিয়ে দেয়া হয়েছে, তেমন কোন সল্যুশন ছাড়াই।

মোটামুটি নাইটমেয়ারিশ অভিজ্ঞতা। বাংলাদেশে থাকতে এটলিস্ট ডাক্তারের দেখা পাওয়া যেতো।

বাংলাদেশের সাথে যদিও কম্পেয়ারবল না। তারপরো সেখানে কিছু বলার সুযোগ আছে। এখানে চেচামেচি করলে হাসপাতাল থেকেই বের করে দিবে।
________________

হেলথ কেয়ার কানাডার সরকারের সবচে খরচান্ত খাত। কানাডাতে হেলথ কেয়ার অনেকটাই ফ্রি। ডাক্তার দেখাতে, যেকোন রোগের চিকিৎসা নিতে টাকা লাগে না। দাঁতের ডাক্তার দেখাতে টাকা লাগে অথবা ইন্সুরেন্স লাগে, চোখের ডাক্তারের লাগে। আর ঔষধ কিনতে টাকা লাগে। বেশীর ভাগ সময় ভালো চাকুরিতে ইন্সুরেন্স প্রভাইড করা হয়।

আদতে হেলথ কেয়ার ফ্রি মনে হলেও ডাক্তাররা/হাসপাতাল ঠিকই চার্জ করে সরকারকে। প্রতিটা ভিজিট/প্রতিটা চিকিৎসা দাম সরকারকে শোধ করতে হয়। এখানে কোন হেলথ কেয়ারের জন্য প্রাইভেট ইন্সুরেন্স নাই। সরকারই ইন্সুরেন্স প্রভাইড করে। আর সেটা সবার ট্যাক্সের সাথে কেটে রাখে।

কানাডার ট্যাক্স পৃথিবীর মধ্যে সবচে বেশীর তালিকায় ১ থেক ১০ এর মধ্যেই থাকবে। আমাদের অন এ্যাভারেজ, যারা মোটামুটি ভালো চাকরি করে তাদের ২৮-৩০ পার্সেন্ট ট্যাক্সে চলে যায়।
শুনতে শোনা যায় ১০০,০০০ ডলারের চাকরি, কিন্তু সেখান থেকে ৩০ হাজার ডলারের মতো ট্যাক্সে চলে যায়।

এতো টাকা ট্যাক্স দিয়েও আমরা ন্যুনতম চিকিৎসাটা পাই না।

এটার পিছনে কারণ অবশ্য ইউনিভার্সাল হেলথ কেয়ার না। এটার পিছনে কিছু মাফিয়া জড়িত। যেমন : কেন এতো সময় লাগে চিকিৎসা পেতে, কারণ হচ্ছে ডাক্তারের শর্টেজ। প্রতিবছর হাজারো ডাক্তার ইমিগ্রেন্ট হয়ে আসলেও এদের মধ্যে খুব লাকি আর ব্রাইট অল্প কয়েকজন ডাক্তার হিসাবে জয়েন করতে পারে। বাকী সব কানাডিয়ান ডাক্তারদের জন্য বরাদ্ধ থাকে।

তাহলে এতো এতো ইমিগ্রেন্ট ডাক্তার আনার কারণটা কি?

এদের বেশীর নার্সের চাকুরিতে জয়েন করে, অথবা অন্য কোন ট্রেনিং নিয়ে হেলথ কেয়ার রিলেটেড কোন চাকুরীতে ঢুকে যায়।

সরকারের দাবী হচ্ছে- হেলথ কেয়ারে পিছনে প্রচুর খরচ হচ্ছে। তাই আরো বেশী ডাক্তার নেয়া যাবে না।

আরো মজার ব্যাপার হচ্ছে, কোন সেন্ট্রালাইজ রোগীর ডাটাবেজ নাই।

সর্দি কাশি, অল্প কিছু ব্যাথা নাশক অষুধ কোন ধরনের ডিস্কাশন ছাড়াই কেনা যায়। বাকী সব ধরনের অষুধের জন্য আপনি ডাক্তারের কাছে যেতে বাধ্য। ডাক্তারের কাছে গেলেই ডাক্তার সরকারের কাছে চার্জ করে। আর কারণে অকারণে ডাক্তারের কাছে যেতে বলে।

যেমন আমার ঘুমের জন্য মেলাটনিন নেয়। এটা স্লিপ পরীক্ষায় এসেছে। আমাকে ফোন করে এক ডাক্তার বলছে তোমাকে মেলাটনিন নিতে হবে। ইতিমধ্যে আমি স্লিপ ক্লিনিক থেকে মেলাটনিন কিনে খেয়েও ফেলছি। অথচ এই কলের জন্য ডাক্তার সরকারের কাছে টাকা নিবে।

এই রকম হাজারো কারণে ডাক্তার সরকারের কাছ থেকে টাকা চার্জ করে। যে কারণে হেলথ কেয়ারের পিছনে বাজেটের অধিকাংশ টাকা খরচ হয়।

এছাড়াও প্রতিবার নিজের ডাক্তার দেখাতে গেলে সেখানে মিনিমাম দু’ঘন্টা লাগে ডাক্তারের সাথে দেখা করতে।

নিজের পার্সোনাল অভিজ্ঞতা দেখেছি, ডাক্তারের চিকিৎসায় আমার তেমন কোন উপকার কখনো হয়নি। হোমিওপ্যাথি বিশ্বাস করি না আমি। কিন্তু আমার মনে হয়, কানাডায় ডাক্তারের কাছে যাওয়া আর হোমিওপ্যাথি খাওয়ার মাঝে গুণগত কোন পার্থক্য নাই ।

আমার মেয়ের স্কিনে ভাইটালিগোর সমস্যা আছে। ৪-৫ টা ডাক্তার দেখিয়ে গত পাঁচ বছরে কোন সুফল পাইনি।

অবশ্য এটার জন্য আমার মেয়ের গোয়ার্তুমিও কিছুটা দায়ী।
____

এই হলো কানাডার হেলথ কেয়ার সিস্টেমের বাস্তব অবস্থা। দেশে থাকলে টাকার বিনিময়ে চিকিৎসা সম্ভব। এখানে টাকা দিয়েও সময় মতো চিকিৎসা পাওয়া যাবে না। টাকা দেয়ার সিস্টেম না।

অবশ্য ইউনিভার্সাল হেলথ কেয়ারের বড়ো বেনিফিটও আছে। আপনি ধনী হন আর গরীব, দেরীতে হলেও আপনি চিকিৎসা পাবেনই। আপনার চাকরী বা টাকাকড়ির উপর চিকিৎসা নির্ভর করবে না।

বাংলাদেশ আর আমেরিকার মতো ক্যান্সার জাতীয় কিছু হলে দেউলিয়া হবার সম্ভবনা নাই।

যতো ভালো সিস্টেম হৌক ইউনিভার্সাল হেলথ কেয়ার, আমার পার্সোনাল অভিজ্ঞতা দুঃস্বপ্নের মতো। নিজের বেলায় আমি চিকিৎসা নেবার আগে ধুকে ধুকে মরে যেতে রাজি। তারপরও  এদের নখরামি দেখতে ইচ্ছা করে না।

সামনেই কানাডার সরকার আরো ১৫ লাখ ইমিগ্রেন্ট আনবে আগামী ৩ বছরে। এমনিতে যে শোচনীয় অবস্থা হাসপাতালে, সে সময় কি যে অবস্থা হবে, কে জানে।

এই লেখার উদ্দেশ্য কানাডাকে খারাপ বলা নয়। কানাডা আমার অত্যন্ত প্রিয় দেশ। এখানকার অধিকাংশ সিস্টেম ভালো। হেলথকেয়ার এই অবস্থার জন্য ঘোর পুজিবাদি সিস্টেম আর মাফিয়া চক্র দায়ী।

আজকে ইমার্জেন্সি রুমে মহিলার মারা যাওয়ার খবর দেখা মনে হলে এই বিষয়ে নিজের অভিজ্ঞতা লিখে রাখা দরকার। সেই কারণে এই লেখার অবতারনা।

চমেক
ডেন্টাল সার্জন, ময়মনসিংহ। 


আরও দেখুন: