রেসিডেন্সি কোর্স : আশা বনাম বাস্তবতা
‘‘রেসিডেন্সি কোর্স : আশা বনাম বাস্তবতা’’ লিখেছেন ডা. সেরাজুস সালেকিন
রেসিডেন্সি কোর্স বর্তমান বিশ্বে চিকিৎসা ক্ষেত্রে উচ্চতর শিক্ষা তে সর্বাধিক স্বীকৃত কারিকুলাম। বাংলাদেশে বর্তমান প্রচলিত কোর্সের যাত্রা শুরু ২০১০ সাল থেকে। শুরুর কিছু বছর এটা শুধুই বিএসএমএমইউ-তে সীমিত ছিল। পরবর্তীতে দেশের অনেক গুলো মেডিকেল কলেজে এটি বিস্তার লাভ করে।
আমি ২০১০ সালে বিএসএমএমইউ তে রেসিডেন্সি কোর্স এর প্রথম ব্যাচের ছাত্র ছিলাম cardiovascular and thoracic surgery কোর্সে। শিক্ষা জীবনের শেষে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে Thoracic Surgery বিভাগে যোগ দেই।
প্রথমে রেসিডেন্সি কোর্স ছাত্র হিসেবে এবং পরবর্তিতে রেসিডেন্সি কোর্স এর শিক্ষক হিসেবে দুটার অভিজ্ঞতা হচ্ছে। আমার কাছে নিঃসন্দেহে এটি competent চিকিৎসক তৈরির একটা ভালো প্রক্রিয়া। এতে হাতে কলমে কাজ দেখার শেখার সুযোগ আছে। সেই সাথে পাঁচ বছর বিভাগের শিক্ষক শিক্ষার্থীদের ভালো করে জানতে পারেন। তাদের দেখভাল করতে পারেন।
আশা : আমাদের কোর্স মূলত অষ্ট্রেলিয়া ও কানাডা কোর্সের মিলিত রূপ। যদিও আমরা এখনো তাদের মত সর্বোচ্চ মানে পৌঁছুতে পারিনি। শিক্ষার্থীর পুরো পাঁচ বছর নিংড়ে নিবে এই কোর্স। একজন শিক্ষার্থীর জন্য একজন সুপারভাইজার থাকবেন। শিক্ষার্থীর ট্রেনিং চলাকালীন তার প্রশিক্ষণ দেখবেন। ভুল শুধরে দিবেন। রোগীর ফিজিক্যাল এক্সামিনেশন দেখিয়ে দেবেন। সার্জারি হাতে কলমে দেখবেন। ব্লক পরীক্ষায় যাচাই করবেন। শিক্ষার্থী পুরো পাঁচ বছর পড়া ব্যতীত কিছুই করবে না। শিক্ষার্থী ব্যর্থ হলে শিক্ষক জবাবদিহিতার আওতায় আসবেন। শিক্ষার্থী ও কোনোরূপ ফাঁকি দেবে না। শিক্ষার্থী নিয়মিত ভাবে লগ বই সংরক্ষণ করবে। তার হোস্টেল হবে হাসপাতাল থেকে কাছে। তার গবেষণার খরচ হাসপাতাল বহন করবে। সে পাঁচ বছর ভাতা পাবে। ব্লক পরীক্ষায় বারবার ফেইল হতে পারে এটাকে বলে formative assessment সাথে থাকবে portfolio। আর ফাইনাল ইয়ারে হবে summative assessment। যদি সে সব ব্লক শেষ অবধি satisfactory পায় তবে ফাইনাল পরীক্ষায় তার কোনো এক্সাম হবে না। পরীক্ষক তার থিসিস, portfolio আর আগের রেজাল্ট দেখবেন। এবং তাকে কৃতকার্য ঘোষণা করবেন।
বাস্তবতা: শিক্ষার্থী গতানুগতিক ভাবে শুধুই ডিউটি করতে থাকে। সে রেগুলার লগ বই সংরক্ষণ করে না। নিয়মিত পড়ে না। হাতে কলমে কাজ শিখতে আপত্তি আবার শেখানোর মত শিক্ষক কম। কারণ রেসিডেন্সি তে প্রশিক্ষণ এর জন্য আর পরীক্ষা নেবার জন্য প্রচুর লোকবল লাগে। বিভাগের ধারণ ক্ষমতার বেশি শিক্ষার্থী ভর্তি হয়। নিয়মিত ব্লক পরীক্ষা হয় না। শিক্ষার্থী ফেইল করলে পুরো দায় তার। শিক্ষক এখানে কোনো জবাবদিহিতার আওতায় আসেন না। ব্লক পরীক্ষা হলেও তাতে স্ট্রাকচার্ড এক্সাম হয় না। রেসিডেন্সি তে ভাইভা ও হয় স্ট্রাকচার্ড। অর্থাৎ সব শিক্ষার্থী একই প্রশ্নের উত্তর দিয়ে পাশ করবেন। আর উত্তর এর key words আগেই প্রস্তুত থাকবে শিক্ষকের কাছে। এখানে শিক্ষকের নিজ পছন্দ মত উত্তর বাছাই এর সুযোগ নেই। এটা মডারেশন করার পর প্রস্তুত হয়। ব্লক পরীক্ষা তে বারবার ফেইল আবার ফাইনাল পরীক্ষায় বারবার ফেইল। শিক্ষার্থী থিসিস নিজের থেকে করে না। কপি পেস্ট করে অনেক ক্ষেত্রে। বাইরে থেকে টাকা দিয়ে করিয়ে নেয়। থিসিসের গাইড কোনো কোনো ক্ষেত্রে সময় দিয়ে সহযোগিতা করেন না। শিক্ষার্থী আবাসন নিজ দায়িত্বে খুঁজে নেয়।
তুলনামূলক আলোচনা আরো অবকাশ রয়েছে। সেটা পক্ষে আবার বিপক্ষেও। এতে লাভ নেই। বরং আমি বলব যারা কোর্স এ আছেন বা ঢুকতে যাচ্ছেন তারা এই পাঁচ বছর কষ্ট করে নিজেকে তৈরি করেন। হতাশার কোনো শেষ নেই। তেমনি আশার আলো কম না। কে কি বলল আর করলো সেটা না ভেবে বরং নিজের সর্বোচ্চটুকু কাজে লাগিয়ে এগুতে হবে।
আমাদের প্রায় সবার অভ্যাস পাঠ্য বইয়ের পরিবর্তে চটি বই পড়া। এটা না করে পাঠ্য বই কয়েক বার পড়ে তারপর অন্য বই পড়ুন। নিজে হাতে লিখে নোট করেন। স্যারে দের লেকচার নোট করেন। রাউন্ডে যা বলা হয় লিখে রাখেন। আমাদের বড় দুর্বলতা হলো রোগীর এক্সামিনেশন আর ভাইভা। তাই সপ্তাহে একটি দিন অন্তত রোগীর গায়ে হাত দিন। ফাইন্ডিংগুলো বন্ধুর কাছে ভাইভা আকারে বলেন। ব্লক পরীক্ষা সিরিয়াসলি নিয়ে নিজেকে তৈরি করেন। লগ বই সংরক্ষণ করা উচিত। সার্জারিতে অংশ নিন। হোক সেটা অবজারভার বা ট্রলি দায়িত্ব। চোখে দেখেন কাজগুলো। বাসায় ফিরে বইয়ে সেটা পড়ে ফেলেন।
পাঁচ বছরে প্রতিটা দিন কাজে লাগান। এর মাঝেই নিজের পরিবারকে ও সময় দিতে হয়, আয় করতে হয়। মুখে বলা সহজ করা কঠিন। কিন্তু মনে রাখতে হবে এই কোর্স এর শিক্ষা আমার আয় এর পথ বের করবে। এটা আমার রুটি রুজির অংশ। সর্বোপরি রোগীদের সাথে সহমর্মী আচরন করুন। তাদের সময় দিন। একেক জন রোগী একটা বই। একটা কেস একটা রোগের চ্যাপ্টার।
সবাইকে নতুন পথ চলার আন্তরিক শুভেচ্ছা।
Dr Serajus Salekin
MS (CVTS)
Assistant Professor
Thoracic Surgery
DMCH.