বাংলাদেশের চিকিৎসক: টাকা কামানোর মেশিন!

ডা সেরাজুস সালেকিন
2022-12-02 19:50:46
বাংলাদেশের চিকিৎসক: টাকা কামানোর মেশিন!

ডা সেরাজুস সালেকিন

বাংলাদেশের চিকিৎসক: টাকার কামানোর মেশিন!

উপরের বাক্যটির শেষে যদি প্রশ্নবোধক চিহ্ন বা আশ্চর্যবোধক চিহ্ন না দিতাম, তবে সাধারণ মানুষের কাছে এটি হতো " অতি সাধারণ এবং সঠিক উক্তি" ।

দেশে এখন চিকিৎসক সংখ্যা এক লাখের বেশি। আর প্রতি বছর যোগ হয় প্রায় দশ হাজার এর কাছাকাছি। সরকারি চিকিৎসক প্রায় তিরিশ হাজার। আর বাকি সবাই ব্যক্তিগত ভাবে কিংবা বেসরকারিখাতে নিযুক্ত।

সরকারি চিকিৎসক চাকুরীতে প্রবেশের পর মূল বেতন বাইশ হাজার টাকা। সব মিলিয়ে সর্বোচ্চ ৩৫হাজার টাকা। অপরদিকে বেসরকারি খাতে কুড়ি হাজার থেকে শুরু। ক্ষেত্র বিশেষে পঁচিশ হাজার। এগুলো মূলত জুনিয়র চিকিৎসকদের বেতন। টাকার অঙ্ক কিছুটা কম বেশি হতে পারে।

জুনিয়র চিকিৎসকদের কথা আগে বলেছি এই কারণে যে, মোট চিকিৎসকদের সংখ্যার এদের অংশ সিংহভাগ। আর এই জুনিয়রদের অনেকেই চাকুরী খোজ করে হন্যে হয়ে। আমি নিজেও কত জুনিয়রদের আকুতি শুনি প্রায়ই।

পাঁচ বছরের প্রচণ্ড রকমের খাটুনি শেষে তারা গ্রাজুয়েট হন। এরপর যারা উচ্চতর ডিগ্রি অর্জন করতে চেষ্টা করেন তাদের একই সাথে আয়, পড়াশুনা এবং পরিবার নিয়ে পথ চলতে হয়।

সাধারণ মানুষ যারা বিশেষত শহরে থাকে, অসুস্থ হলে প্রাইভেট হাসপাতালে যায় । তাদের চোখে জেষ্ঠ্য চিকিৎসকদের ঝা চকচকে জীবন চোখে পড়ে, রোগীর লম্বা লাইন চোখে পড়ে। মনে রাখতে হবে জেষ্ঠ্য চিকিৎসকদের সংখ্যা মোট চিকিৎসকদের এক তৃতীয়াংশ হবে। আর এই চিকিৎসকরা জুনিয়র দের পথ পারি দিয়েই এসেছেন। আর সব জুনিয়র একটা সময় শেষে সিনিয়রদের অবস্থানে এসে পৌঁছাতে পারে না।

যে চিকিৎসকদের বাবা মা ও চিকিৎসক এবং পেশায় নিয়োজিত, তারা তাদের সন্তানের যুদ্ধ অনুধাবন করতে পারেন। আর যে সব চিকিৎসকদের পরিবারে সেটা নেই তাদের বাবা মা শুধু সন্তানের পড়ালেখার সময়ের কষ্ট অনুধাবন করতে পারেন কিন্তু পেশাগত জীবনের সংগ্রাম বা পরিশ্রমের সাথে আয়ের অসংগতির হিসেব মিলাতে বা বুঝতে চান না। তাদের কাছে মনে হয় সন্তান ডাক্তার হয়েছে, উচ্চতর ডিগ্রি হাসিল করেছে। এখন তার পকেট ভারী হবার কথা।

চিকিৎসকদের লেখাপড়ার সংগ্রাম সারা বিশ্বে একই প্রায়। উন্নত বিশ্বে সুবিধা এটুকু যে চিকিৎসকদের একটা নূন্যতম সম্মানজনক আয় থাকে, যেটা তার পরিশ্রম আর মেধার সাথে সঙ্গতিপূর্ণ। এরপর যে যত বেশি কাজ করবে, দক্ষ হবে, তার অবস্থান ততোই উপরে যাবে। আর ঠিক এই বিষয়টা আমাদের দেশে হয় না।

ক্লাসের সামনের সারিতে বসা শিক্ষার্থী হয়তোবা চিকিৎসক এর খাতায় নাম লিখিয়েছে, কিন্তু পেশাগত জীবনে তার পেছনে থাকা বন্ধুটি একই বয়সে তারও আগে তার থেকে বহু এগিয়ে গেছে। সেই এগিয়ে যাওয়া টাকা পয়সা দিক থেকে আর সামাজিক দিক থেকে।

একজন ব্যবসায়ী বিনা লাভ করে একটি পণ্য বিক্রি করেন না। আর তার পেশার কাজে সহায়তা করার জন্য কর্মী থাকে পাশে। ক্ষেত্র বিশেষে মালিকের অনুপস্থিতিতে পণ্য বিক্রি করেন। প্রতিষ্ঠানে মালিক নেই বলে ক্রেতা কম মূল্যে জিনিস কিনতে পারেন না। আর মালিক কোনো কারণে অনুপস্থিত থাকলেও বিক্রীত পণ্যের আয় ঠিকই তার ঘরে পৌঁছে।

একজন চিকিৎসকের সহযোগী কেউ হয় না, তার আয় তাকেই করতে হয়। কত চিকিৎসক যে কত ভাবে বিনা পারিশ্রমিকে রোগীদের চিকিৎসা পরামর্শ দেন এটা চিকিৎসক ব্যতীত কেউই বুঝবে না। ক্ষেত্র বিশেষে পরীক্ষানিরীক্ষা কম বা বিনা মূল্যে করানো, এমনকি ওষুধের ব্যবস্থা করার ঘটনা ঘটে অহরহ । আমাদের পেশা সবার কাছে সেবা। আর বাকিদের পেশা শুধুই পেশা। আমাদেরকে বিনা পারিশ্রমিকে কাজ করে রোগীদের দোয়া নিয়ে সন্তুষ্টি অর্জন করতে হবে। এমন টা অনেকে মনে করেন। আপনি চিকিৎসক, আপনি সেবা করবেন, আপনার টাকা লাগবে কেনো?? ভাব খানা যেনো এই!

পেশাগত জীবনের সংগ্রাম নেই, এমন কোনো পেশাই নেই, এই দেশে। তবে পার্থক্য হলো যে, সর্বোচ্চ মেধা নিয়ে কাজ করা এই চিকিৎসক , তার মেধা ও যোগ্যতার সমানুপাতিক বিনিময় মোটেই পান না। আর যারা পান সেটা অনেক দেরি করে, বেশ বয়স পার করে পান। ততদিন তার নিজের জীবন উপভোগ করার ইচ্ছা, বয়স এবং সময় সব মরে যায়। আমি এই ব্যাপারটা এভাবে বলি যে, " মাংস কেনার সামর্থ্য হয়েছে, কিন্তু ততদিনে দাঁত পড়ে গেছে"।

যোগ্যতার সঠিক মূল্যায়ন এবং সঠিক সময়ে মূল্যায়ন এই দেশে কখনোই হয় না। এটা আশা করাই বাহুল্য। এরপরেও হয়তো কিছু কষ্ট রয়ে যায়, কিছু কথা থেকে যায়।

পরিশেষে একটি ছোট্ট গল্প বলব। বাদশা আকবরকে বীরবল বলছিলেন, এই রাজ্যে রোগীর থেকে চিকিৎসকের সংখ্যা বেশি। বাদশা আকবর সেটার প্রমাণ চাইলেন। তখন বীরবল দরবারে উপস্থিত হয়ে সকলের উদ্দেশে বলেন যে, সে খুবই অসুস্থ বোধ করছে, তার তীব্র মাথা ব্যাথা করছে। এটা শুনে সভায় উপস্থিত প্রায় সবাই নানা রকমের চিকিৎসা পরামর্শ দিতে শুরু করলো। আর রাজ বদ্যি অসহায়ের মত চুপ করে রইলো। আর ওইদিকে বীরবল মুচকি হেসে বাদশা আকবর দিকে তাকিয়ে রইল।

এই দেশে পথে ঘাটে চিকিৎসক ঘুরে বেড়ায়। এই দেশে আর আমাদের কি মূল্যায়ন হবে।


আরও দেখুন: