এইডস : বিশ্বজুড়ে অন্যতম জনস্বাস্থ্য সমস্যা
মরণব্যাধী এইডস নিয়ে লিখেছেন ডা. মো : ফখরুল আবেদীন জনি
২০২২ সালের ওয়ার্ল্ড এইডস দিবসের মূল থিম বা প্রতিপাদ্য বিষয় “Putting ourselves to the Test : Achieving Equality and End HIV”। বাংলায় বুঝায় সবাইকে টেস্টের আওতায় আনতে হবে। সমতা অর্জন করে এইচআইভি শেষ বা নির্মূল করতে হবে। ১৯৮৮ সাল থেকে প্রতি বছর পয়লা ডিসেম্বর বিশ্ব এইডস দিবস হিসাবে পালিত হয়ে আসছে। বাংলাদেশসহ সারাবিশ্বে এটি অন্যতম জনস্বাস্থ্য সমস্যা। মানবাধিকারের বিভাজন, বৈষম্য এবং উপেক্ষা এইচআইভি জয় করার ক্ষেত্রে অন্তরায়। পরীক্ষা-নিরীক্ষা এবং চিকিৎসার ক্ষেত্রে সাধারণ মানুষের জন্য অসমতা দূর করে সব ধরনের সুযোগ সুবিধা নিশ্চিত করতে হবে। অসাম্যের সমাপ্তি না ঘটাতে পারলে এইডস বা এইচআইভি শেষ বা নির্মূল করা যাবে না।
এইচআইভি ভাইরাস একজন থেকে অন্যজনে ছড়িয়ে পড়তে পারে রক্ত সঞ্চালন, এইচআইভি আক্রান্ত সুই এবং যৌন সম্পর্কের মাধ্যমে। এছাড়া এইচআইভি বহনকারী মহিলা থেকে গর্ভাবস্থায় এবং প্রসবকালীন সময়ে তার সন্তানের নিকট এ ভাইরাস বিস্তার লাভ করতে পারে। এইডস তখনই হয় যখন এইচআইভি সংক্রমণের কারণে কারো রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থা নষ্ট হয়ে যায়।
১৯৮৯ সালে প্রথম বাংলাদেশ এইচ,আই,ভি রোগ সনাক্ত হয়। ২০২০ সালে, যা ২০২১ সালে রিপোর্ট মতে৩৭ দশমিক ৭ মিলিয়ন মানুষ এইচ আইভি সংক্রামিত হয়ে বেচে আছে। ১ দশমিক ৫ মিলিয়ন মানুষ নতুন করে আক্রান্ত হয়।প্রায় ৬ লক্ষ ৮০ হাজার মৃত্যু হয় এই রোগের কারনে।
বাংলাদেশে যদি এই চিত্র দেখি তাহলে, ৬ লক্ষ পরীক্ষায় প্রায় ৭২৯ জন সনাক্ত হয়। যার মাঝে রোহিঙ্গা ছিল ১৮৮ জন। এর মধ্য ৭৬% পুরুষ, ২২ %মহিলা এবং ২% হিজরা সম্প্রদায়। যদি বয়স বিবেচনা দেখি- তাহলে ২৫-৪৯ সবচেয়ে বেশি প্রায় ৬৭%। ১৯-২৪ বছরে আক্রান্ত প্রায় ১৬%। এই রোগে গেল ২০২০ সনে মারা যায় ২০৫ জন।
এই রোগকে নিমূল করতে হলে সবাইকে টেস্টে আওয়াতে আনতে হবে। কিন্তু সামাজিক প্রেক্ষাপটে যা খুবই কঠিন কাজ। যদি সনাক্ত হয়, তাহলে তার চারপাশের সামাজিক অবস্থা তার জন্য বন্ধুসুলভ হয়। কেউ যেন অবহেলা না করে, এসব সরকার, স্বাস্থ্য বিভাগ এককভাবে সম্ভব নয়। সামাজিক সচেতনার মাধ্যমে এই রোগকে বিশ্ব থেকে নিমূল সম্ভব। এখন পর্যন্ত ৮,৭৬১ জন এই রোগে দেশে আক্রান্ত হয়েছে। প্রায় ১৫০০ জন এই রোগে মারা যায়। এই যদি সবাই মিলে জনসচেতন না হই। তাহলে এইডস এর নীরব মহামারী হবে।
সবার সচেতনতার জন্য এইচআইভি সংক্রমণের কিছু লক্ষণ জানা প্রয়োজন যা নিম্নরূপ :
ক. দ্রুতগতিতে ওজন কমে যাওয়া এবং অনবরত দুর্বলতা অনুভব করা। এটি ওয়াসটিং সিনড্রোম নামে পরিচিত।
খ. স্মৃতিশক্তি ধীরে ধীরে নষ্ট হওয়া। ঘুম ঘুম ভাব হতে পারে ব্রেনের সংক্রমণের কারণে। বিভ্রান্তি সৃষ্টি হতে পারে। এটি এইচআইভি এনসেফালোপ্যাথি নামে পরিচিত। ওয়াসটিং সিনড্রোম এবং এইচআইভি এনসেফালোপ্যাথি উভয়ই এইডস সংজ্ঞায়িত বা সংশ্লিষ্ট অসুস্থতা।
গ. রাতের বেলায় শরীর প্রচণ্ড ঘেমে যাওয়া।
ঘ. কিছু স্থানের লসিকাগ্রন্থি ফুলে যাওয়া।
ঙ. এক সপ্তাহের বেশি সময় ধরে ডায়রিয়া থাকলে।
চ. জিহ্বা বা মুখের ভিতর ব্যতিক্রমধর্মী দাগ দেখা দিলে।
এইডস লিম্ফোমার সাথে সংযুক্ত থাকতে পারে। লিম্ফোমা এক ধরনের ক্যান্সার যার সাথে শ্বেত রক্তকণিকা জড়িত। তার মানে এই নয় যে, মুখের এবং শরীরের লক্ষণসমূহ দেখা দিলেই কেউ এইচআইভি আক্রান্ত হয়েছেন বা এইডস রোগ আছে এমনটি ভাবা মোটেও ঠিক নয়। এ ক্ষেত্রে আপনার চিকিৎসক প্রয়োজন মনে করলে আপনাকে প্রয়োজনীয় পরীক্ষা করতে দিতে পারেন। এইচআইভি পরীক্ষার ফলাফল পজেটিভ হওয়ার অর্থ এই নয় যে আপনার এইডস রোগ হয়ে গেছে। এমন অনেক মানুষ দেখা গেছে যারা এইচআইভি পজিটিভ কিন্তু অনেক বছর তাদের কোনো লক্ষণই দেখা যায়নি। তাই এ ধরনের কোনো সমস্যায় অবশ্যই চিকিৎসকের পরামর্শ গ্রহণ করবেন।
এইডস আক্রান্ত রোগীদের রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থা দুর্বল থাকায় সংক্রমণের ঝুঁকি থাকে। এইচআইভি আক্রান্ত রোগীদের ক্ষেত্রে ভাইরাস যেন এইডসের দিকে অগ্রসর হতে না পারে বা যাদের এইডস হয়েছে তাদের ক্ষেত্রে এআরটি থেরাপি অর্থাৎ এন্টিরেট্রোভাইরাল থেরাপি কার্যকর প্রমাণিত হয়েছে। এন্টিরেট্রোভাইরাল থেরাপি এইডস রোগীর ওপর কাজ করলে রোগীর ওজন ধীরে ধীরে বৃদ্ধি পায়। এইচআইভি এবং এইডস উভয় ক্ষেত্রেই এআরটি থেরাপি আপনাকে স্বাস্থ্যবান রাখে। থেরাপির পরে যদি রোগীর ওজন বৃদ্ধি পায় তাহলে বুঝতে হবে চিকিৎসা কাজ করছে।
তাই বাঁচতে হলে শুধু জানলেই হবে না, অন্যকে জানানোর মাধ্যমে সামাজিক সচেতনতা সৃষ্টির লক্ষ্যে একযোগে কাজ করতে হবে। এই পরীক্ষা সম্পূর্ন বিনামূল্যে হয়ে থাকে। চিকিৎসার ক্ষেত্রেও সর্বাধিক সহযোগিতা করে থাকে।
তাই সামাজিক সচেতনতা তৈরি মাধ্যমে এইডস বিদায় দেই পৃথিবী থেকে।
ডা. মো : ফখরুল আবেদীন জনি
ডিস্ট্রিক্ট স্যার্ভিলেন্স মেডিকেল অফিসার
সিভিল সার্জন অফিস, কুমিল্লা।