ডায়াবেটিসের সবচেয়ে সফল ও জনপ্রিয় চিকিৎসা!
‘ডায়াবেটিসের যে চিকিৎসা সবচেয়ে সফল ও জনপ্রিয়’- লিখেছেন ডা. এজাজ বারী চৌধুরী
॥ ১ ॥
প্রথমে মেসেজ পাঠালো আমার চাচাতো বোন। কয়েকদিন পর একই মেসেজ পাঠালেন সেনাবাহিনীতে উচ্চপদে আসীন আমার এক বড়োভাই। সবশেষে গতকাল মেসেজ আসলো আমার খুব কাছের একজন সাংবাদিক ভাইয়ের কাছ থেকে।
তিনটি মেসেজে ছিলো তিনটি গল্পের লিংক। টান টান উত্তেজনার সেসব গল্পে, জমজমাট গল্পের উপাদান সবই ছিলো, কিন্তু ছিলোনা কেবল সত্যের ছিঁটেফোঁটাও। সাংবাদিক ভাইয়ের পাঠানো লিংকটা দেখে বেশি অবাক হয়েছি। প্রথম আলো পত্রিকার গেটআপ হুবহু নকল করে, সেখানে সংবাদ আকারে বসানো হয়েছে সেই গল্প। আগের গল্পগুলি ছিলো ফেসবুকে বিজ্ঞাপন হিসেবে স্থান পাওয়া, আর এটা যেন জাল টাকা বিলিয়ে মানুষের বিশ্বাস কেনার চেষ্টা করা!
॥ ২ ॥
তিনটি গল্পেরই ভিলেন ছিলো ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণের কার্যকর ঔষধ, ইনসুলিন ও চিকিৎসকেরা এবং নায়ক ছিলো Glucozero নামক এক ন্যাচারাল বা অর্গানিক মেডিসিন যাকে সব ভিলেনরা অন্ধ কুঠুরীতে বন্দী করে রেখেছিলো। এখন সেই Glucozero গোপন বন্দীশালা থেকে পালিয়ে এসে ভিলেনদের উপর প্রতিশোধ নিচ্ছে এবং একের পর এক ডায়াবেটিস রোগীকে চিরকালের জন্য ডায়াবেটিস থেকে মুক্তি দিচ্ছে। মজার ব্যাপার হলো, পৃথিবীর শ্রেষ্ঠতম এই Natural বা Organic Medicine টি কোন ঔষধের দোকানে নয়, কেবল পাওয়া যায় অনলাইন লিংক থেকে অর্ডার করলে!
॥ ৩ ॥
যারা আমাকে লিংকগুলো পাঠিয়েছেন তাঁরা সবাই উচ্চশিক্ষিত এবং কেউই কুসংস্কার আচ্ছন্ন নন। তারপরও গল্পগুলি তাঁরা বিশ্বাস করেছেন অথবা গল্পগুলি তাদেরকে আশার আলো দেখিয়েছে বলেই হয়তো আমার সাথে শেয়ার করেছেন। এরকম বিভিন্ন ঔষধ বিভিন্ন সময়ে একই রকম প্রচারণা চালিয়ে ব্যবসা করে এখন গায়েব হয়ে গিয়েছে। অথচ প্রতিটি ঔষধই শুরুতে পেয়েছিলো পাহাড়সম আস্থা এবং জনপ্রিয়তা।
শুধু ঔষধ কেন, অতি জনপ্রিয় জ্ঞানপাপীর সুক্ষ্ণ এবং সুদূরপ্রসারী প্রতারণার জালে এখনো লক্ষ লক্ষ মানুষ আটকা পড়ে আছে।
এর কারণগুলো খুঁজে বের করার চেষ্টা করলাম। প্রায় সবক্ষেত্রেই চারটি ধাপ অনুসরণ করা হয়েছে।
# ডায়াবেটিস রোগটার উৎপত্তি, বিস্তার এবং শরীরের ক্ষতি করার প্রতিটি মেকানিজমকে মিথ্যে এবং দূর্বোধ্য তথ্য দিয়ে সাজানো হয়। যারা ডাক্তার নন, তাদের পক্ষে এই কারচুপি বোঝা সম্ভব নয়।
# যে রোগ সারার নয়, সেই ডায়াবেটিসকে সারাতে না পারার ব্যর্থতার দায় চাপানো হয় বিজ্ঞানসম্মত এবং কার্যকর ঔষধ এবং ইনসুলিনের উপর৷ শুধু তাই নয়, ডায়াবেটিসের সমস্ত ঔষধকে শরীরের জন্য বিষ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। বিষমুক্ত Natural বা Organic Medicine ই যে ডায়াবেটিসের একমাত্র কার্যকর এবং সফল চিকিৎসা, সেটা প্রমান করা হয়। ঔষধ বা ইনসুলিন ছাড়া সুস্থতার স্বপ্ন দেখানো এসব ঔষধ বা চিকিৎসা পদ্ধতি এজন্য শুরুতেই তুমুল জনপ্রিয়তা পায়।
# অচেনা কোন এক বিদেশী ব্যক্তির ছবি ব্যবহার করে তাকে বিশ্ববিখ্যাত ডাক্তার হিসেবে পরিচয় করিয়ে তার interview এর নাম করে এসব ঔষধের মিথ্যে ও কাল্পনিক গুণগান গাওয়া হয়। অথবা বিদেশী প্রতিষ্ঠানের স্বীকৃতি পাওয়া বলে প্রচার করা হয়।
# এসব ঔষধের সুফল পাওয়া এবং ডায়াবেটিস থেকে চিরমুক্তি পাওয়া কিছু চরিত্রের অবতারনা করে, মানুষের মাঝে আশার আলো জাগানো হয়।
তাদের গল্পগুলো এমন হয় যে, এই ঔষধ বা চিকিৎসা পদ্ধতি তাদেরকে নতুন জীবন দিয়েছে... এতোটা সুস্থ তারা জীবনে কখনো ছিলেন না। এখন কোন ঔষধ বা ইনসুলিনও লাগেনা... ইত্যাদি, ইত্যাদি৷ এই পর্বটা ডায়াবেটিস রোগিদের ভেতর এসব ঔষধ ব্যবহার করার বা কোন ডায়েট যেমন কিটো ডায়েটের প্রতি তীব্র বাসনা তৈরী করে দেয়।
॥ ৪ ॥
আজ ১৪ নভেম্বর বিশ্ব ডায়াবেটিস দিবস৷ এবছরের Theme, "Education to protect tomorrow." একজন ডায়াবেটিস রোগি বছরে যদি ৬ বারও ডাক্তার দেখান এবং প্রতিবার ১০ মিনিট করে সময় পান, তাহলে ১ বছরে অর্থাৎ ৮৭৬০ ঘন্টার মধ্যে মাত্র ১ ঘন্টা ডাক্তারের সান্নিধ্য পান। এই সময়টুকু তার অবশিষ্ট ৮৭৫৯ ঘন্টা সুষ্ঠু ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে করনীয় এবং অন্যান্য প্রয়োজনীয় জ্ঞানলাভের জন্য একেবারেই অপ্রতুল। শুধু ঔষধ লিখে দেয়াই ডায়াবেটিসের চিকিৎসা নয়। ডায়াবেটিস চিকিৎসার সফলতা নির্ভর করে রোগির সচেতনতা এবং জ্ঞানের উপর৷
এজন্যই বিশ্বের কিছু উন্নত দেশে চালু হয়েছে, "Therapeutic Patient Education (TPE)." এটি চিকিৎসা সহায়ক শিক্ষা কার্যক্রম, যার মাধ্যমে রোগি ডায়াবেটিস সম্পর্কে বিশদ ও স্বচ্ছ ধারণা পান, ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রনে করণীয় সম্পর্কে গভীর জ্ঞানার্জন করেন, নতুন নতুন টেকনোলজির সাথে পরিচিত হন, সেগুলো নির্ভুলভাবে ব্যবহার করতে শেখেন৷ অর্থাৎ ডাক্তার তখন হয়ে ওঠেন কোচ এবং রোগী হয়ে ওঠেন বিজয়ী খেলোয়াড়।
॥ ৫ ॥
আমাদের দেশেও হয়তো একদিন TPE চালু হবে৷ আর তখন মানুষকে বোকা বানিয়ে ডায়াবেটিসের সব ধরণের অপচিকিৎসাই বন্ধ হবে।
Glucozero র মতো ঔষধের প্রলোভন হোক বা কোন জ্ঞানপাপীর সুক্ষ্ণ-সুদূরপ্রসারী প্রতারণার জালই হোক - সবই মানুষের ঘৃণায় প্রত্যাখ্যাত হবে৷ ক্ষতিকর কিটো ডায়েট প্রয়োগ করে সুগার কমানোর ম্যাজিক, কোরআন হাদীসের নির্দেশিত জীবনযাপন পদ্ধতিকে নিজের আবিস্কৃত Lifestyle হিসেবে প্রচার ও তার সুফলকে নিজের কৃৃতিত্ব হিসেবে প্রচার করা, যেই USFDA তিন চার স্তরের গবেষণা চালিয়ে মানুষের স্বাস্থ্যের জন্য নিরাপদ প্রমানিত না হলে কোন ঔষধের অনুমোদন দেয়না, সেই USFDA এর অনুমোদনের মিথ্যে তথ্য দিয়ে গাছ গাছড়া দিয়ে বানানো মিশ্রন Natural বা Organic medicine নামে বিক্রি করা.. ইত্যাদি অপকর্মও বন্ধ হবে।
কারণ, জ্ঞানের আলোয় আলোকিত মানুষকে বেশিদিন অন্ধ বানিয়ে রাখা যায়না।