সর্বাঙ্গে ব্যথা ওষুধ দিব কোথা?
অধ্যাপক ডা. রাশিদা বেগম
সম্প্রতি এক কনফারেন্সে জানতে পারলাম (অনেকেই আগেই জেনে থাকতে পারেন) যে কারো ক্রোমজোমের টেলোমিয়ারের লেংথ যত কম, তার আয়ু তত কম। এর পর থেকে আমার টেলোমিয়ারের লেংথ মেপে দেখার খুব ইচ্ছে। প্রায় সাড়ে ছয় দশক বয়সেও অনেক কিছু (অবশ্যই চিকিৎসা সংক্রান্ত) করতে ইচ্ছে করে। সেটা করার জন্য ক্ষেত্র তৈরীর করার জন্য যথেষ্ঠ সময় টেলোমিয়ার দিবে কিনা সেটা জানার জন্য।
সুখের কথা হোল, টেলোমিয়ার ছোট হয়ে যাবার অসংখ্য কারণগুলোকে পাশ কাটাতে পারলে টেলোমিয়ার আর ছোটতো হবেইনা, বেড়েও যেতে পারে।
তাই আমি ছোট হয়ে গেল কিনা এই চিন্তা না করে আর যাতে ছোট না হয় সেই চেষ্টা করতে চাই। এই টেলোমিয়ার ছোট হবার অনেক কারনের মধ্যে একটি উল্লেখযোগ্য কারণ হোল "পরিবেশ দূষণ"।
এই পরিবেশ দূষনে আছে মাটি, পানি ও বাতাস দূষন আর এই তিনের মিশ্রনে ফুড চেইন দূষণ।
ফার্টিলাইজার, ইন্সেক্টিসাইড, প্রিজারভেটিভ, খাবারে মিশ্রিত রং এবং কিছু কিছু ক্ষেত্রে খাবার তৈরি করার এবং রাখার পাত্র ফুড চেইন দূষনের জন্য প্রধানত দায়ী।
আর এসব দূষিত হচ্ছে মানুষেরই দৈনন্দিন কর্মকান্ড দিয়ে।
প্রতিবছর ১২ মিলিয়ন প্লাস্টিক বর্জ সাগরে নিক্ষেপ করা হয়। এভাবে চলতে থাকলে ২০৫০ সালের মধ্যে মাছেরা বিলুপ্ত হতে পারে। প্রতি বছর ২৬.৪ মিলিয়ন বন উজাড় করা হচ্ছে।
এভাবে চলতে থাকলে আগামী ৭৮ বছরের মধ্যে বন উজাড় হয়ে যাবে। প্রতি বছর ৮.৪ মিলিয়ন লোক মারা যাচ্ছে বাতাসের দূষণে। তার মধ্যে ৩.৫ মিলিয়ন ঘরের বাতাস দূষণে। ২০২১ সালে ৪০৬.১ মিলয়ন টন কার্বন ডাই অক্সাইড বাতাসে মিশেছে যার মূল উৎস স্টীল প্রোডাকশন।
আর দূষকরা হচ্ছে :
১। হেভি মেটালঃ মার্কারী, লেড, ক্যাডমিয়াম, জিংক, কোবাল্ট, নিকেল ইত্যাদি। দূষিত হচ্ছে মাটি, পানি এবং ফুড চেইন। কিছু কিছু হেভি মেটাল যেমন ক্যাডমিয়াম শরীরে ১০ থেকে ৩০ বছর পর্যন্ত থাকতে পারে। অর্থাৎ মায়ের শরীর থেকে বাচ্চার শরীরেও যেতে পারে।
কিছু কিছু হেভি মেটাল যেমন জিংক, ম্যাঙ্গানিজ স্বল্প মাত্রায় শরীরের জন্য প্রয়োজন হলেও উচ্চ মাত্রায় টক্সিক। কিছু কিছু যেমন মার্কারী, লেড আবার যে কোন মাত্রায় ক্ষতিকর।
পানি দূষণের ফলে অনেক মাছ হেভি মেটাল দিয়ে দূষিত হচ্ছে।
বাতাসের দূষণের উপাদান যানবাহন ও কলকারখানার ধোঁয়া, রাস্তার ধুলাবালি, পেস্টিসাইড, সিগারেটের ধোঁয়া প্রত্যক্ষ এবং পরোক্ষ (স্মোকার স্বামীর জন্য স্ত্রী পরোক্ষভাবে এফেক্টেড হয়)। পৃথিবীর সর্বাধিক দূষিত বাতাসের দেশের মধ্যে বাংলাদেশ অন্যতম। কখনও কখনও প্রথম হয়ে থাকে। সম্প্রতি এক গবেষণায় দেখা গেছে ঢাকার বাতাস বিপদসীমার চেয়েও ১৫ গুন বেশী দূষিত।
প্রসাধনীতে ব্যবহৃত বিভিন্ন কেমিক্যাল, প্লাস্টিক বোতল, ফিডার এবং হাড়ি পাতিলে ব্যবহৃত কেমিক্যালও বিভিন্ন ভাবে ক্ষতিকারক।
কি ক্ষতি করে?
কি নয়? অসংখ্য শারিরীক সমস্যার উৎস এই দূষন। শব্দ দূষণেও শারিরীক সমস্যার উৎপত্তি হয়। এই দূষন ছেলে মেয়ে উভয়ের শুক্রানু ও ডিম্বানু কমিয়ে দিচ্ছে ভয়াবহ ভাবে। পেস্টিসাইড ব্যবহার করা হয় যে সব এলাকায়, তার আশেপাশের মানুষও এফেক্টেড হয়। সম্ভবত এ কারণেই আমরা প্রচুর কৃষক পাচ্ছি যাদের স্পার্ম নেই।
কিভাবে সমাধান করা যায়?
দূষণের দুষ্টুচক্রকে ব্যাক গিয়ারে নিয়ে যেতে হবে। খাবার যেন বিষাক্ত না হয়। বেগুন খাওয়া বাদ দিয়ে নয়।
বেগুন পুড়িয়ে ভর্তা, ভেজে ভর্তা, বেগুন ভাজি, টক বেগুন, ডিম বেগুন, মাছ বেগুন, বড়ি বেগুন, বেগুনের আচার, সর্বোপরি বেগুনী। স্বাদ ও গুনে ভরা এই বেগুনকে কৃষকরা এবং কর্তৃপক্ষ যাতে নিরাপদ রাখে সেটাই গবেষকের বার্তা। এই সব টক্সিক্যান্টের একটা নিরাপদ মাত্রা থাকে। সেই মাত্রা বিদ্যমান রাখতে হবে।
তবে শুধু কি বেগুন? কি মাছ, কি মাংস, কি ফল, কি সব্জী, অজস্র খাবার পরীক্ষা করলে পাওয়া যাবে এই ভয়াবহ চিত্র। ম্যানকোযেব নামে একটি ফাংগিসাইড ব্যবহার হয় আলু, টমেটো, আপেল, কলা, আঙ্গুর এগুলোকে রক্ষা করার জন্য। এটিরও ক্ষতিকর দিক আছে।
যে বাতাস আমাদের বাঁচিয়ে রাখে, সে বাতাসই আবার মৃত্যুকে এগিয়ে নিয়ে আসে। যে খাবার আমাদের বাঁচিয়ে রাখে, সে খাবারই আবার মৃত্যুকে এগিয়ে নিয়ে আসে।
আমরা দূষণে দূষনে জর্জরিত। এ যেন সর্বাঙ্গে ব্যথা, ওষুধ দিব কোথা।