স্বেচ্ছায় গর্ভপাত
ডা. তাসলিমা বেগম
আমি হলাম ফার্টিলিটি স্পেশালিষ্ট, আমার পেশা নিঃসন্তান দম্পতিদের চিকিৎসা ও কাউন্সেলিং। দিন শেষে রক্ত মাংস গড়া একজন অতি সাধারন মানুষ হিসাবে এই নিঃসন্তান মানুষগুলো হাহাকার আমার হৃদয়কেও স্পর্শ করে। চেম্বার শেষ করে বাসায় চলে আসলেও মাঝে মাঝে রোগীদের কষ্টের কাহিনীর রেশ মনের মধ্যে থেকেই যায়, মনটা ভার হয়ে থাকে। সব সময় চেষ্টা এবং চিন্তা কিভাবে এদেরকে আরেকটু ভালো সাহায্য করা যায়। আমার চিন্তা চেতনা জুড়ে আছে কিভাবে একটা নিঃসন্তান দম্পতিকে সন্তানসম্ভবা করে তুলব। একটা এমব্রায়োকে ফিটাস পর্যন্ত নিয়ে, অবশেষে কিভাবে একটা মানব শিশু আকারে মায়ের কোলে তুলে দিব। আমি ব্যক্তিগতভাবে গর্ভপাতের কঠোর সমালোচক। সাধারণত আমার বেশীরভাগ রুগিই ইনফার্টাইল রুগি।
কদিন আগে এক অত্যাধুনিক ইয়ং কাপল আসলো একটা ভিন্ন সমস্যা নিয়ে। তারা জানতে চায়, তারা গর্ভপাতের ঔষধ খেয়ে ফেলেছে দুদিন আগে এখন তারা এই বাচ্চাটা আর নষ্ট করতে চাচ্ছেন না, কোন সমস্যা হবে কিনা বা কি করা যায় জানতে এসেছে। এহেন পরিস্থিতিতে মনে মনে মেজাজ চড়ে গেলেও মাস্কের আড়ালে বহু কষ্টে সেটা গোপন করলাম।
বললাম ঠিক আছে , ঔষুধ যখন খেয়েই ফেলেছেন এর একটা ইফেক্ট তো গর্ভস্থ ভ্রূণের উপরে পরারই কথা। তবে এ মুহূর্তে রোগীর আলট্রাসনোগ্রাম করে আগে দেখে নিতে হবে ভ্রুনটা এখনো বেঁচে আছে কিনা। আল্ট্রাসনোগ্রাম করলাম দেখলাম সাত সপ্তাহের গর্ভ এবং সুন্দর ফিটাল হার্ট মুভমেন্ট দেখা গেল। ওদের স্বামী-স্ত্রী দুজনকেই ফিটাল হার্ট মুভমেন্ট দেখালাম। ওরা আশ্বস্ত হলো, আমি সাপোর্টেড ট্রিটমেন্ট দিয়ে বাড়ি যেতে বললাম এবং ৭ দিন পরে পুনরায় আসার জন্য অনুরোধ করলাম।
ইতিমধ্যেই আমি রোগীকে প্রশ্ন করে জানতে পেরেছি, তারা চার বছর ধরে বিবাহিত জীবন যাপন করছে এবং বছর দুয়েক আগে আরো একবার একইভাবে গর্ভপাত করেছে। এবারও তাদের অসতর্কতা বশত পুনরায় গর্ভধারণ করে ফেলে,যদিও তারা আরো কিছুদিন পরে সন্তান নিতে চেয়েছিল। কিন্তু এবার গর্ভপাতের ঔষধ খাওয়ার পরে ভদ্রমহিলার মনে মারাত্মক গিল্টি ফিলিংস হতে থাকে, তাই তারা সিদ্ধান্ত নেয় বাচ্চাটা রেখে দিবে। এখন আমার কাছে জানতে চাচ্ছে এতে বাচ্চার কোন ক্ষতি হবে কিনা। আমি বললাম, এত ছোট অবস্থায় আমার বলার সাধ্য নেই আদৌ কোন ক্ষতি হবে কিনা। আর মানব ভ্রূণের উপর এবর্টিফিকেন্ট মেডিসিনের কি কি ইম্পেক্ট হতে পারে এমন গবেষণা ইথিক্যালি সম্ভব নয়, এবং অনলাইনে গবেষণা পত্রও নেই। বিধায় আমার পক্ষে বলাও সম্ভব নয় ভবিষ্যতে আসলে কি হবে। আমি উনাদেরকে বললাম, আমি আপনাদেরকে ১৬-১৮ সপ্তাহ পর্যন্ত ফলো আপ করি, অ্যানোমালি স্ক্যান করি, এরপর যদি খারাপ কিছু পাওয়া যায় তখন পরিস্থিতি অনুযায়ী সিদ্ধান্ত নেওয়া যাবে।
গত পরশু রাতে রোগীটি হোয়াটসঅ্যাপে মেসেজ পাঠায় যে, তার মাসিকের রাস্তায় রক্ত যাচ্ছে। আমি রক্ত বন্ধ হওয়ার জন্য ওভার টেলিফোন কিছু চিকিৎসা দিলাম এবং পরদিন চেম্বারে আসতে বললাম। পুনরায় আলট্রাসনোগ্রাম করলাম, যদিও পার ভেজাইনাল ব্লিডিং হচ্ছে, তবুও দেখলাম ভ্রুনটা বেঁচে আছে, কাউন্সিলিং এবং চিকিৎসা দিয়ে পুনরায় এক সপ্তাহ পর আসতে বললাম।
এই ঘটনাটা আমার মনের মধ্যে বেশ একটা ইম্প্যাক্ট ফেলেছে। প্রশ্ন হলো কোন্ দম্পতি কখন সন্তান ধারণের চেষ্টা করবেন সেটা একান্তই তাদের ব্যক্তিগত ব্যাপার। তবে কেউ যদি এই মুহূর্তে সন্তান নিতে না চান তাকে অবশ্যই কোন না কোন জন্মনিয়ন্ত্রণের পদ্ধতি গ্রহণ করা উচিত।
কারণ স্বেচ্ছায় ঔষধ খেয়ে পুনঃ পুনঃ গর্ভপাতে স্বাস্থ্য ঝুঁকি রয়েছে। ধর্মীয়ভাবে ভ্রুণ হত্যা আর মানুষ হত্যা যে সমান অপরাধ, এ বিষয়ে যাদের জ্ঞান নেই তাদের সাথে চেম্বারে বসে অযথা তর্কে জড়াতে চাই না।
তথাপি কারো ব্যক্তিগত বিষয়ে হস্তক্ষেপ না করে, তাদের সম্মান রেখে আমার পক্ষে যতটুকু বুঝানো সম্ভব আমি সাধারনত গর্ভপাত করতে আসা দম্পতিগুলোকে সর্বোচ্চ লেভেল থেকে চেষ্টা করি। আর দম্পতি যদি কনফিউজড থাকেন যে, বাচ্চাটা রাখবেন কি রাখবেন না- তাহলে আরো বিপদ। যেটা আমার রুগিটার ক্ষেত্রে হয়েছে। কনফিউজ থাকলে আসলে মারাত্মক গিলটি ফিলিংস হয়। যা পরবর্তীতে বিশালাকার মানসিক বিপর্যয় ডেকে আনতে পারে।
তাই সকলের প্রতি অনুরোধ বাচ্চা নিতে না চাইলে অবশ্যই আপনার জন্য উপযুক্ত গর্ভনিরোধক পদ্ধতি গ্রহণ করবেন, প্রয়োজনে আপনার ডাক্তারের সাথে এ বিষয়ে পরামর্শ করে নিন। বারবার গর্ভপাত করা বা ইমারজেন্সি পিল খাওয়া জন্মনিয়ন্ত্রণের কোন পদ্ধতি নয়।