পরিবারের প্রিয় মানুষদের হক নষ্ট করে আপনাদের সেবা করি

ডা. রাজিকুল ইসলাম রাজিব
2022-10-24 10:17:15
পরিবারের প্রিয় মানুষদের হক নষ্ট করে আপনাদের সেবা করি

ডা. রাজিকুল ইসলাম রাজিব

আমার প্লেটে গরম খিচুড়ি। বাম হাতে টিভির রিমোর্ট। মুখে ভাত পুরে দিতে দিতে রিমোর্টের সুইসে চাপ দিয়ে দেওয়ালে আটকানো LED টিভিটি অন করলাম। টিভির পর্দায় ভেসে এলেন একজন সাংবাদিক। তার পেছনে রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল। তার রিপোর্টের মূল বিষয় হল রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল ইন্টার্ণ ডাক্তার শূন্য। ফলশ্রুতিতে চিকিৎসা সেবা ব্যহত হচ্ছে। কথাটি অনেকাংশেই সত্য।
হঠাৎ-ই তার পাশে একটি অটো এসে থামল। অটোতে একজন গর্ভবতী মহিলার পাশে দুইজন নারী। সাংবাদিকের প্রশ্ন কৈ যান ? অটোতে বসা বয়স্ক মহিলার উত্তর, " সিজার করানোর জন্য এসেছিলাম। তিন ঘন্টা ধরে অপেক্ষা করে কোন চিকিৎসা না পেয়ে চলে যাচ্ছি।" এই সংবাদ দেখে দেশের সিংহভাগ জনগণ এই বয়স্কা মহিলাটির কথা বিশ্বাস করে নিবে।

কিন্ত একজন ডাক্তার হিসাবে আমি প্রকৃত বিষয়টি বুঝতে পারব। আসলে মহিলাটির হাসপাতালে আসার মূল কারণ ছিল সিজার। কিন্ত ডাক্তার তাকে পরীক্ষা করে দেখেছেন যে আসলে তার সিজার লাগবে না। নরমালেই বাচ্চা হবে। আর তার জন্য সময় লাগবে। জরায়ুর মুখ একটি নির্দিষ্ট পরিমাণে চওড়া হওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে। সে অনুযায়ী তাকে চিকিৎসা ও নির্দেশনা দুটোই দেওয়া হয়েছিল। কিন্ত রোগী বা রোগীর লোকেরা এই সামান্য ধৈর্য্য না ধরে হাসপাতাল থেকে বেরিয়ে প্রাইভেট ক্লিনিকের দিকে দৌড় দিয়েছেন। আর রাস্তার মাঝে সাংবাদিক বন্ধুর সাথে দেখা। আর সাংবাদিক বন্ধুও এদিক ওদিক না তাকিয়ে একটা ভুল তথ্য কান পাতলা জাতির কাছে পেশ করলেন।

আমার এই দশ বছরের ডাক্তারী জীবনের অভিজ্ঞতায় দেখেছি এ দেশের বেশিরভাগ সাধারণ মানুষ ডাক্তার বিদ্বেষী। তারা সরকারী বা বেসরকারী হাসপাতালে গিয়ে কোন না কোন সময় বিড়ম্বনার স্বীকার হয়েছে। যা বেশিরভাগ-ই ডাক্তারের সাথে সম্পর্কিত নয়। যেসব বিষয়ে ডাক্তারের কোন হাত-ই নেই। আসলে ডাক্তারের ভাবনা হওয়া উচিত শুধু রোগ আর রোগী নিয়ে। কিন্ত এদেশের ডাক্তারদের রোগ ও রোগীর বাইরে অনেক কিছু নিয়ে ভাবতে হয়। তারা অনেক সীমাবদ্ধতা ও অপ্রতুলতার মধ্যে দিয়ে কাজ করে।

ছোট থেকে নিয়মানুবর্তিতার মধ্য দিয়ে বড় হওয়া ছেলেমেয়েরাই ডাক্তারী পড়ার সুযোগ পায়। সেবার এই পথে টিকে থাকতে অনেক ধৈর্য্য ও একাগ্রতার প্রয়োজন। এই বন্ধুর পথে টিকে থাকা বেশ কঠিন। একজন ডাক্তারের পরিবারের লোকজন এবং নিকটজন ব্যতীত তার দৈনন্দিন জীবনের উত্তাপের আঁচ অন্য মানুষ পায় না। তার জীবনের সংগ্রাম আর ত্যাগের অণুগল্পগুলো বাইরের সাধারণ মানুষ জানতে পারে না। তাদের দীর্ঘশ্বাসের ভাপ কেউ অনুভব করে না।

আমার এই ছোট্ট সময়ের ডাক্তারী জীবনে অনেক সহকর্মীদের পেয়েছি। অনেক ইন্টার্ণ ডাক্তার আর মেডিকেল স্টুডেন্টদের সাহচার্য পেয়েছি। বেশিরভাগই তারা ব্যক্তি হিসাবে অসাধারণ। তাদের চিন্তাভাবনা ও মানসিকতা অনেক উন্নত। তাদের সেবার মান নিয়ে অবশ্যই প্রশ্ন উঠতে পারে, কথা হতে পারে। কিন্ত মনে রাখতে হবে সেই ব্যর্থতার দায় কোন ডাক্তারের নয়, সেই দায় স্বাস্থ্য সেবার সিস্টেমের।

কাদের বিরুদ্ধে আজ প্ল্যাকার্ড ধরেছেন? কাদেরকে আজ কসাই বলে গালি দিচ্ছেন? কাদের বিরুদ্ধে স্লোগান দিয়ে রাজপথ মুখরিত করছেন? দিন শেষে কিন্ত আপনাকে তাদের কাছেই আসতে হবে। বৃদ্ধ মা-বাবা, নিজের বউ-বাচ্চা নিয়ে তাদের দরজাতেই ধরনা দিতে হবে। মেসেন্জার- হোটসঅ্যাপে তাদেরকেই নক করতে হবে। জীবন সায়াহ্নে তাদের হাতটিই শক্ত করে ধরতে হবে।

আমরা আপনাদের নির্মম ব্যবহার আর কটু কথা মনে রাখি না। একজন অসুস্থ মানুষ দেখলে আমরা সবকিছু ভুলে যাই। আর একজন ডাক্তারের চোখে সবচেয়ে সুন্দর দৃশ্য হল, তার রোগীর মুখের হাসি।

আমরা আমাদের পরিবারের প্রিয় মানুষদের হক নষ্ট করে আপনাদের সেবা করি। নিজের বাচ্চার জন্য বরাদ্দ সময়গুলো আপনার জন্য ব্যয় করি। আমরা দায়িত্বের অতিরিক্ত দায়িত্ব পালন করি। ধন্যবাদ দেওয়ার কোন প্রয়োজন নেই। কিন্ত দয়া করে গালিগালাজ করবেন না। আপনাদের অশালীন বক্তব্য আমাদের কাজের গতিকে মন্থর করে।

মানব সেবা আমার নেশা, তীব্র নেশা।


আরও দেখুন: