সেই বৃদ্ধের ছেলের কথাগুলি আজও আমার কানে বাজে
ডা. রাজিবুল ইসলাম রাজিব
তখন আমার পোস্টিং উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে। আমার জন্ম হয়েছিল যে হাসপাতালে সে হাসপাতালেই আমার প্রথম পোস্টিং ছিল। ইনডোর আর আউটডোর দুই মিলিয়ে ডিউটি করতাম। ইনডোরে ভর্তি রোগী খুব একটা মারা যেত না। কারণ ক্রিটিক্যাল রোগীদের চিকিৎসা শুরু করার পর টারশিয়ারী হাসপাতালে রেফার্ড করা হত। একদিন অতিশয় এক বৃদ্ধ ব্যক্তি সপ্তাহ খানেক হাসপাতালে চিকিৎসার পর মারা গেলেন। তার ছেলেদের অনেকবার বলার পরও বৃদ্ধ বাবাকে রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে যেতে রাজি হননি। রোগী এবং রোগীর ছেলেদের একই কথা, যা হবে এখানেই। শেষ পর্যন্ত আমাদের সকল চেষ্টা ব্যর্থ করে রোগীটি মারা গেল।
হাসপাতাল থেকে বাবার লাশ নিয়ে যাওয়ার সময় এক ছেলে আমাকে বললেন," আপনার ব্যবহার আর চিকিৎসায় আমরা অত্যন্ত সন্তুষ্ট। আপনি যদি আমার বাবার জানাযার নামাজে আসতেন তাহলে খুব খুশি হতাম।"
ভদ্রলোকের কথাটি আমার অন্তর ছেদ করে গেল। একটা ভাল লাগার পবিত্র অনুভূতিতে মনটা ভরে গেল। সাধারণত কোন রোগী সুস্থ হলে তার স্বজনরা ডাক্তারকে ধন্যবাদ দেয়। কিন্ত উনার বাবা মারা যাওয়ার পর উল্টো আমাকে ধন্যবাদ দিচ্ছেন এবং জানাযার নামাজে শরীক হওয়ার দাওয়াত দিচ্ছেন। আমি এ ধরণের দাওয়াত আগে কখনও পাই নি।
আমি যোহরের নামাজের পর মোটরসাইকেলের পিছনে বসে অজানা-অচেনা এক গ্রামের উদ্দেশ্যে রওয়ানা হলাম। উদ্দেশ্য বৃদ্ধ ব্যক্তিটির জানাযার নামাজ। সেদিন প্রায় ঘন্টা দুয়েক সেখানে ছিলাম। সেই দুই ঘন্টার অনুভূতি অন্য রকম ছিলাম। মনটা ছিল বরফ শীতল। শত ব্যস্ততার মাঝে পরিবারের লোকদের আতিথেয়তাও ছিল প্রশংসার উর্ধ্বে।
সেদিনের পর থেকে নিয়ত করলাম আমার চিকিৎসাধীন কোন রোগী মারা গেলে আর সময় ও সুযোগ মিললে তার জানাযার নামাজে অংশ নিব। তার জন্য দোয়া করব। নিজের মৃত্যুর কথা স্মরণ করব। রাজশাহী মেডিকেলে এসে সে সুযোগ তেমন আর হয়ে ওঠেনি। তবে শিশু বিভাগে ভিন্ন ভিন্ন সময় দুইজন ব্লাড ক্যান্সার রোগে মারা যাওয়া শিশুর জানাযায় অংশ নিয়েছিলাম।
বর্তমানের চাকচিক্যের দুনিয়া আমাদেরকে মৃত্যুর স্মরণকে ভুলিয়ে রাখতে বাধ্য করেছে। জাগতিক কর্মকান্ডে আমরা এতটাই ব্যস্ত যে, মৃত্যু নামক নীরস বিষয়টি মাথাতেই আসে না। যার ফলে হাজার হাজার পাপ করার পরেও আমাদের কোন অনুশোচনা নেই, কোন ভাবাবেগ নেই। আমরা কোন স্বাভাবিক মৃত্যুকেও মেনে নিতে চাই না।
জানাযার নামাজ মানুষের মনে ভাবাবেগ সৃষ্টি করে। জানাযার নামাজে নিজের মৃত্যুর কথা স্মরণ হয়।
সেই বৃদ্ধ ব্যক্তিটির ছেলের কথাগুলি আজও আমার কানে বাজে। সেই জানাযার নামাজের কথা আজও মনে পড়ে। এক মিশ্র অনুভূতিতে মনটা ভরে ওঠে।
লেখক : অ্যাসিস্ট্যান্ট রেজিস্ট্রার, পেডিয়াট্রিকস বিভাগ, রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল।