বধিরদের আশার আলো কক্লিয়ার ইমপ্লান্ট

ইকরাম সালিহ
2022-10-08 13:53:29
বধিরদের আশার আলো কক্লিয়ার ইমপ্লান্ট

জন্মগত বধিরদের ক্ষেত্রে ৫ বছর বয়সের আগে, ২-৩ বছর বয়সে ইমপ্লান্ট করলে ভালো ফলাফল আশা করা যায়

মানুষ মহিমা পায় কর্মের ভেতর দিয়ে। সমাজে এখনও এমন অনেকে আছেন, যিনি নীরবে নিজেকে অন্যের জন্য বিলিয়ে দিচ্ছেন। আপন কর্মে হয়ে উঠছেন স্মরণীয়-বরণীয়। তেমনি একজন ডা. হারুন-অর রশিদ তালুকদার ইয়ামিন। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের নাক কান গলা বিভাগের সহকারী এই অধ্যাপক সম্প্রতি অন্য রকম এক সেঞ্চুরি করেছেন। জন্মগত বধির ১০০ শিশুকে অস্ত্রোপচারের মাধ্যমে তিনি পৃথিবীর শব্দ শোনার সুযোগ করে দিয়েছেন; ফিরিয়ে দিয়েছেন কথা বলার শক্তি। ডক্টর টিভিকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে ডা. হারুন-অর রশিদ তালুকদার ইয়ামিন বধির শিশুর শ্রবণ ও বাকশক্তি আনার বিশেষায়িত চিকিৎসা কক্লিয়ার ইমপ্লান্ট সার্জারির আদ্যোপান্ত বলেছেন। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন ইকরাম সালিহ

ডক্টর টিভি: কক্লিয়ার ইমপ্লান্ট কি, কখন করাতে হবে?
ডা. হারুন-অর রশিদ: কক্লিয়ার ইমপ্লান্ট একটি ইলেকট্রনিক ডিভাইস, যা মারাত্মক বা সম্পূর্ণ বধির ব্যক্তিকে শব্দ শুনতে সহায়তা করে। এটি রাথোনিক ইয়ার নামেও পরিচিত। মারাত্মক বা সম্পূর্ণ শ্রবণ প্রতিবন্ধী শিশু অথবা বয়স্ক ব্যক্তি, যারা উচ্চ ক্ষমতা সম্পন্ন হিয়ারিং এইড ব্যবহারেও ভালো শুনতে পান না, তাদের এটি প্রয়োজন হয়। অস্ত্রোপচারের মাধ্যমে অন্তঃকর্ণের কক্লিয়াতে ডিভাইসটির একাংশ স্থাপন করা হয়। ডিভাইসের অন্য অংশ কানের বাইরে থাকে। দুটির সমন্বয়ে বধির ব্যক্তি শব্দ শুনতে পান। জন্মগত বধিরদের ক্ষেত্রে ৫ বছরের আগেই কক্লিয়ার ইমপ্লান্ট করা গেলে সবচেয়ে ভালো ফলাফল পাওয়া যায়।

ডক্টর টিভি: কক্লিয়ার ইমপ্লান্ট কিভাবে কাজ করে?
ডা. হারুন-অর রশিদ: বিভিন্ন রোগে কক্লিয়া ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে মারাত্মক বধিরতা তৈরি হতে পারে। কক্লিয়ার ইমপ্লান্ট অন্তঃকর্ণের ক্ষতিগ্রস্ত কক্লিয়াকে বাইপাস করে অডিটরি নার্ভকে উত্তেজিত করার মাধ্যমে শব্দকে মস্তিষ্কে পৌঁছাতে সহায়তা করে। কয়েকটি ধাপে কক্লিয়ার ইমপ্লান্ট কাজ করে—
> বাইরের পরিবেশের শব্দ প্রথমে মাইক্রোফোনের মাধ্যমে গৃহীত হয়। পরে এটি এনালগ ইলেকট্রিক সিগনালে পরিবর্তিত হয়।
> স্পিচ প্রসেসর সিগনালকে প্রসেসিং করে কোডেড ডিজিটাল সিগনালে রূপান্তরিত করে। ট্রান্সমিটার কয়েলের মাধ্যমে কোডেড সিগনাল রেডিও ফ্রিকোয়েন্সির মাধ্যমে ইন্টারনাল রিসিভার স্টিমুলেটরে পাঠায়।
> রিসিভার স্টিমুলেটর কোডেড সিগনালকে ইলেকট্রিক ইমপালসে পরিবর্তিত করে ইলেকট্রোডে পাঠায়।
> ইলেকট্রোড ইলেকট্রিক ইমপালসকে অডিটরি নার্ভের মাধ্যমে মস্তিষ্কে পাঠায় এবং মস্তিষ্ক সেটিকে শব্দ হিসেবে চিহ্নিত করে।

কক্লিয়ার ইমপ্লান্টে প্রত্যাশিত ফলাফল নির্ভর করে কয়েকটি বিষয়ের ওপর—
> জন্মগত বধিরদের ক্ষেত্রে ৫ বছর বয়সের আগে, ২-৩ বছর বয়সে ইমপ্লান্ট করলে ভালো ফলাফল আশা করা যায়।
> কথা শেখার পর শ্রবণশক্তি ক্ষতিগ্রস্ত হলে তাদের ক্ষেত্রে ভালো ফলাফল মেলে।
> পরিবার, বন্ধুবান্ধবদের কাছ থেকে যথার্থ সহায়তা ও অনুপ্রেরণার ওপর অনেক কিছু নির্ভর করে।
> ইমপ্লান্ট পরবর্তী প্রশিক্ষণ গ্রহণের ওপর ফলাফল অনেকটা নির্ভরশীল।

ডক্টর টিভি: কক্লিয়ার ইমপ্লান্টের প্রস্তুতি কিভাবে নিতে হবে?
ডা. হারুন-অর রশিদ: ইমপ্লান্টের আগে আমরা অডিওলজিক্যাল, রেডিওলজিক্যাল, সাইকোলজিক্যালসহ কিছু পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে থাকি। অডিওলজিক্যাল পরীক্ষার মধ্যে Otoacoustic emission, BOA, PTA, Tympanometry, Aided audiogram, ABR, ASSR, Speech Audiometry এবং রেডিওলজিক্যাল পরীক্ষার মধ্যে রয়েছে CT Scan of Ear, MRI of Ear. এ ছাড়া জেনারেল অ্যানেন্থেথেসিয়ার কার্যকারিতার জন্য কিছু পরীক্ষা করা হয়।

ডক্টর টিভি: ইমপ্লান্টের ক্ষেত্রে সুইচ অন ও ম্যাপিং বুঝিয়ে বলবেন…
ডা. হারুন-অর রশিদ: সুইচ অন বলতে ইমপ্লান্টের বাইরের অংশের স্পিচ প্রসেসরের সঙ্গে সংযুক্ত ও চালুকরণকে বোঝানো হয়। আর ম্যাপিং হলো ইমপ্লান্টের বিভিন্ন চ্যানেলে শব্দ প্রবেশের পরিমাণ নির্ধারণ। কক্লিয়ার ইমপ্লান্ট সার্জারির ২-৩ সপ্তাহ পর সুইচ অন ও ম্যাপিং করতে হয়। এ কাজটি অডিওলজিস্টরা করে থাকেন। যথার্থ শব্দ শোনার জন্য নিয়মিত মাপিং করা প্রয়োজন হতে পারে।

ডক্টর টিভি: হ্যাবিলিটেশন সম্পর্কে বলবেন…
ডা. হারুন-অর রশিদ: ইমপ্লান্টের পর শব্দ শোনা ও ভাষা শেখানোকে হ্যাবিলিটেশন বলা হয়। জন্মগত বধির শিশুর ক্ষেত্রে হ্যাবিলিটেশনের সেশন কয়েক বছর ধরে চালানো লাগতে পারে।

ডক্টর টিভি: কক্লিয়ার ইমপ্লান্ট যন্ত্র কারা তৈরি করছে, ব্যয় কেমন?
ডা. হারুন-অর রশিদ: বর্তমানে বিশ্বে পাঁচটি কোম্পানি কক্লিয়ার ইমপ্লান্ট তৈরি করছে। তবে অস্ট্রেলিয়ার কক্লিয়ার লিমিটেড, অস্ট্রিয়ার এমইডি-ইএল ও যুক্তরাষ্ট্রের অ্যাডভান্স বায়োনিক্স অন্যতম। কক্লিয়ার ইমপ্লান্ট হলো ডিভাইসভিত্তিক সার্জারি। এখানে যন্ত্র কিনতে হয়, পরীক্ষা-নিরীক্ষা করতে হয়। এর সঙ্গে হাসপাতাল ও হ্যাবিলিটেশন খরচ যুক্ত হবে। কক্লিয়ার ইমপ্লান্ট ডিভাইসের মূল্য কোম্পানি ও মডেল ভেদে ২০ লাখ টাকার মতো। বেসিক টাইপ ইমপ্লান্টের দাম ১০ লাখ টাকার মতো। সরকারি হাসপাতালে করালে অন্যান্য খরচ বাবদ আরও ৫০ হাজারের মতো লাগতে পারে।

ডক্টর টিভি: কক্লিয়ার ইমপ্লান্ট তো টিমভিত্তিক কাজ। এখানে অন্যান্য কি বিষয়ের বিশেষজ্ঞ প্রয়োজন হয়?
ডা. হারুন-অর রশিদ: কক্লিয়ার ইমপ্লান্ট একটি টিমওয়ার্ক। এই টিমে ইএনটি সার্জন, অডিওলজিস্ট, স্পিচ থেরাপিস্ট বা অডিটরি ভারবাল থেরাপিস্ট, সাইকোলজিস্ট ও সমাজকর্মী থাকেন। কক্লিয়ার ইমপ্লান্ট সার্জারি সম্পূর্ণ অজ্ঞান করে করা হয়, ২ থেকে ৪ ঘণ্টা লাগে। কক্লিয়ার ইমপ্লান্টের ভেতরের অংশ (রিসিভার স্টিমুলেটর) কানের পেছনে চামড়ার নিচে হাড়ে স্থাপন করা হয়।  ইলেকট্রোড অংশ কক্লিয়ার ভেতরে স্থাপন করা হয়। অস্ত্রোপচার পরবর্তী অসুবিধা খুবই কম এবং রোগী ২ থেকে ৩ দিন পর হাসপাতাল ত্যাগ করতে পারেন।

ডক্টর টিভি: কক্লিয়ার ইমপ্লান্ট করার আগে কি টিকা নেওয়া দরকার?
ডা. হারুন-অর রশিদ: সাধারণত ৫ বছরের কম বয়সী শিশুদের ক্ষেত্রে ম্যানিনজাইটিস প্রতিরোধে অস্ত্রোপচারের আগে টিকা দেওয়া হয়।

ডক্টর টিভি: কক্লিয়ার ইমপ্লান্ট সার্জারির ক্ষেত্রে ঝুঁকি কেমন?
ডা. হারুন-অর রশিদ: কক্লিয়ার ইমপ্লান্ট সার্জারিতে অজ্ঞানজনিত সমস্যা, মেনিনজাইটিস, ফ্যাসিয়াল নার্ভ ইনজুরি, ইনফেকশন, টিনিটাস, ভার্টিগো সমস্যা হতে পারে। তবে এ জটিলতা খুবই কম দেখা যায়।

ডক্টর টিভি: কক্লিয়ার ইমপ্লান্ট কার্যক্রম কোথায় করা হচ্ছে?
ডা. হারুন-অর রশিদ: বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়, সিএমএইচ ঢাকা, সিএমএইচ চট্টগ্রাম, জাতীয় নাক কান গলা ইনস্টিটিউট ও সিলেট এমএজি ওসমানী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে কক্লিয়ার ইমপ্লান্ট কার্যক্রম রয়েছে।

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের নাক কান গলা বিভাগ ও সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের অর্থায়নে ২০১০ থেকে ২০১৩ সালে ৫৪ শ্রবণ প্রতিবন্ধীকে বিনামূল্যে কক্লিয়ার ইমপ্লান্ট ডিভাইস ও সার্জারি করা হয়। তারা এখন কানে শুনতে ও কথা বলতে পারেন। এরপর ২০১৪ থেকে ২০১৬ সাল পর্যন্ত ১২৭ জনকে স্বল্পমূল্যে কক্লিয়ার ইমপ্লান্ট ডিভাইস এবং সার্জারির পর সবাইকে ভাষা শিক্ষা দেওয়া হয়। শ্রবণ প্রতিবন্ধীর পরিবার নিজ খরচে কক্লিয়ার ইমপ্লান্ট ডিভাইস কিনে দিলে এখানে সার্জারির সুযোগ রয়েছে।

ডক্টর টিভি: গুরুত্বপূর্ণ সময় দেওয়ার জন্য ডক্টর টিভির পক্ষ থেকে আপনাকে অসংখ্য ধন্যবাদ।
ডা. হারুন-অর রশিদ: আপনাকে ও ডক্টর টিভির দর্শক-শ্রোতাদের ধন্যবাদ।


আরও দেখুন: