স্তন ক্যান্সার স্ক্রিনিং জীবন বাঁচায়

ইকরাম সালিহ
2022-10-02 16:22:01
স্তন ক্যান্সার স্ক্রিনিং জীবন বাঁচায়

ডা. মো: হাবিবুল্লাহ তালুকদার রাসকিন। অধ্যাপক ও প্রধান ক্যান্সার ইপিডেমিওলজি বিভাগ, জাতীয় ক্যান্সার গবেষণা ইনস্টিটিউট ও হাসপাতাল।

বিশ্বে স্তন ক্যান্সারে আক্রান্তের সংখ্যা প্রতিনিয়ত বাড়ছে। গবেষণায় দেখা যায়, প্রতি আট জনের মধ্যে একজন নারী স্তন ক্যান্সারে আক্রান্ত হচ্ছেন। পুরুষদের মাঝেও স্তন ক্যান্সার দেখা যায়। বাংলাদেশে প্রতি বছর ১৩ হাজারের বেশি নারী নতুন করে স্তন ক্যান্সারে আক্রান্ত হন। এদের মধ্যে মারা যান ৬,৭৮৩ জন। যদি প্রাথমিক পর্যায়ে স্তন ক্যান্সার দ্রুত শনাক্ত করা যায় তাহলে পুরোপুরি এর নিরাময় সম্ভব।

স্তন ক্যান্সার বিষয়ে ডক্টর টিভির প্রতিবেদক ইকরাম সালিহকে সাক্ষাৎকার দিয়েছেন ডা. মো. হাবিবুল্লাহ তালুকদার রাসকিন। অধ্যাপক ও প্রধান ক্যান্সার ইপিডেমিওলজি বিভাগ, জাতীয় ক্যান্সার গবেষণা ইনস্টিটিউট ও হাসপাতাল এবং প্রধান সমন্বয়কারী, বাংলাদেশ স্তন ক্যান্সার সচেতনতা ফোরাম।

 

 

ডক্টর টিভি: স্তন ক্যান্সার কী?

ডা. হাবিবুল্লাহ তালুকদার: শরীরের অন্যান্য স্থানের মতো স্তনে অস্বাভাবিক কোষ বাড়ার কারণে কোনো চাকা বা পিন্ডের সৃষ্টি হলে তাকে টিউমার বলে। শরীরের বিনা প্রয়োজনে অনিয়ন্ত্রিত কোষ বিভাজ থেকে এর সৃষ্টি। প্রকৃতি বা বৈশিষ্ট্য অনুযায়ী স্তনের টিউমার দুই ধরনের।

১. বিনাইন টিউমার-এটা ক্ষতিকারক নয়। উৎপত্তিস্থলের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকে। দূরের বা কাছের অন্য কোনো অগ্রভাগকে আক্রান্ত করে না।

২. ম্যালিগন্যান্ট টিউমার। যা আগ্রাসী ও ক্ষতিকর। উৎপত্তিস্থলের সীমানা ছাড়িয়ে আশপাশের অঙ্গপ্রত্যঙ্গ কিংবা গ্রন্থি আক্রান্ত করে। এমনকি রক্তপ্রবাহের মাধ্যমে দূরের কোনো অঙ্গেও আঘাত হানতে পারে।

 

ডক্টর টিভি: স্তন ক্যান্সার কোন অংশে হয়ে থাকে?

ডা. হাবিবুল্লাহ তালুকদার: স্তনের ম্যালিগন্যান্ট টিউমারই ক্যান্সার। স্তন ক্যান্সার সাধারণত স্তনের দুধবাহী নালিতে হয়। তবে কিছু ক্ষেত্রে অন্যান্য টিস্যু থেকেও শুরু হতে পারে। একটি পিণ্ড বা চাকা হিসেবেই বেশির ভাগ ক্ষেত্রে এটি প্রথম ধরা পড়ে। ধীরে ধীরে বড় হয়ে শরীরের অন্যত্র ছড়িয়ে পড়ার আশঙ্কা থাকে। স্তনের সঙ্গে কাছাকাছি বগলতলার লসিকাগ্রন্থি বা গ্র্যান্ডগুলোর খুবই ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ থাকায় এগুলোতে ক্যান্সার ছড়িয়ে পড়ার আশঙ্খা সবার আগে এবং সবচেয়ে বেশি।

 

ডক্টর টিভি: স্তন ক্যান্সারের ব্যাপ্তি সম্পর্কে জানাবেন।

ডা. হাবিবুল্লাহ তালুকদার: সারা বিশ্বের মতো বাংলাদেশের নারীদের মধ্যেও স্তন ক্যান্সারে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি বেশি। নারী-পুরুষ মিলিয়ে হিসাব করলেও স্তন ক্যান্সারের স্থান শীর্ষে। প্রতিবছর নতুন করে আক্রান্তের হার এবং মৃত্যুর হার উভয় ক্ষেত্রেই। প্রতিবছর বাংলাদেশে স্তন ক্যান্সারে আক্রান্ত হন ১৩ হাজার ২৮ জন মানুষ। আর মারা যান ৬ হাজার ৭৮৩ জন। নারী ক্যান্সার রোগীদের মধ্যে আক্রান্ত ও মৃত্যু হার যথাক্রমে শতকরা ১৯ ভাগ ও ৬.২ ভাগ।

ক্যান্সার গবেষণার দায়িত্বপ্রাপ্ত আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠান আইএআরসির (ইন্টারন্যাশনাল এজেন্সি ফর রিসার্চ অন ক্যান্সার) ২০২০ পর্যন্ত হালনাগাদ প্রতিবেদন থেকে এই হিসাব পাওয়া গেছে।

আমাদের দেশে জনসংখ্যাভিত্তিক কোনো নিবন্ধন না থাকায় এই প্রতিবেদনের ওপর নির্ভর করতে হয়। দেশের জনসংখ্যা সাড়ে ১৬ কোটি ধরে তাদের এই অনুমিত হিসাব।

 

সেই হিসাবে প্রতিবছর সব মিলিয়ে মোট ১,৫৬,৭৫৫ নতুন করে ক্যান্সারে আক্রান্ত হন, মারা যান ১,০৮,৯৯০ জন ক্যান্সার রোগী।

জাতীয় ক্যান্সার গবেষণা ইনস্টিটিউটের ক্যান্সার নিবন্ধন অনুযায়ীও স্তন ক্যান্সার নারীদের মধ্যে শীর্ষে। আমাদের দেশে এই রোগ সম্পর্কে সচেতনতার অভাবের কারণে বেশির ভাগ ক্ষেত্রে ধরা পড়ে অনেক দেরিতে। এই রোগের বিভিন্ন ঝুঁকি বা রিস্ক ফ্যাক্টর সম্পর্কে মানুষ সচেতন হলে প্রাথমিক প্রতিরোধ কিছু ক্ষেত্রে সম্ভব। তবে সবচেয়ে বেশি দরকার প্রাথমিক অবস্থায় শনাক্ত করা।

 

ডক্টর টিভি: স্তন ক্যান্সারে কি কি ঝুঁকি বা রিস্ক ফ্যাক্টর রয়েছে?

ডা. হাবিবুল্লাহ তালুকদার: দুই ধরনের ঝুঁকি দেখতে পাই।

১.অপরিবর্তনযোগ্য ঝুঁকি

জেন্ডার বা লিঙ্গ: পুরুষেরও স্তন ক্যান্সার হতে পারে। তবে নারীদের আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কা ১০০ গুণ বেশি।

বয়স: বাস বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে স্তন ক্যান্সারের ঝুঁকি বাড়ে। পশ্চিমা বিশ্বে সাধারণত ৫০ বছর বয়সের পর ঝুঁকি বেশি বাড়ে। তবে অজানা কারণে আমাদের দেশে চল্লিশের পরেই বেশি দেখা যায়।

জিনগত: বিআরসিএ-১ ও ২ নামের জিনের অস্বাভাবিক মিউটেশন ৫ থেকে ১০ শতাংশ দায়ী স্তন ক্যান্সারের জন্য।

বংশগত: কারও পরিবারের কোনো নিকটাত্মীয়-যেমন মা, খালা, বড় বোন বা মেয়ে স্তন ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে থাকলে তাঁর স্তন ক্যান্সারের ঝুঁকি বেশি থাকে।

পিরিয়ড /মাসিক: যেসব নারীর ১২ বার বাসের আগে পিরিয়ে এল এব বয়সের পর পিরিয়ড বন্ধ হয়, তাঁদের এ রোগে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি থাকে।

২.পরিবর্তনযোগ্য ঝুঁকি

সন্তান সংখ্যা: নিঃসন্তান নারীদের স্তন ক্যান্সারের ঝুঁকি বেশি থাকে।

বেশি বয়সে সন্তান: ৩০ বছর বয়সের পর বিয়ে প্রথম সন্তানের মা হওয়া ক্যান্সারের ঝুঁকি বাড়ায়।

 

ব্রেস্টফিডিং না করানো: সন্তানকে বুকের দুধ না খাওয়ানোর অভ্যাস স্তন ক্যান্সারের ঝুঁকি বাড়ায়।

খাদ্যাভ্যাস: শাকসবজি ও ফলমূল কম খেয়ে, চর্বি প্রাণিজ আমি জাতীয় খাবার বেশি খেলে ব্রেস্ট ক্যান্সারের ঝুঁকি বাড়ে।

ওজন: অতিরিক্ত ওজন ও শারীরিক পরিশ্রমের অনভ্যাস ঝুঁকি বাড়ায়।

অন্যান্য কারণের মধ্যে আছে তেজস্ক্রিয় বিকিরণ, তামাক জাতীয় দ্রব্যের ব্যবহার, স্তনে সাধারণ কোনো চাকা কিংবা অস্বাভাবিকতা থাকা ইত্যাদি।

 

ডক্টর টিভি: স্তন ক্যান্সার নির্ণয় করা হয় কি ভাবে?

ডা. হাবিবুল্লাহ তালুকদার: দুটি উপায়ে প্রাথমিক অবস্থায় স্তন ক্যান্সার নির্ণয় করা যায়। কোনো লক্ষণ টের পেলে জরুরিভাবে চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়া এবং প্রয়োজনীয় পরীক্ষা করানো উচিত। আবার যাঁদের মধ্যে লক্ষণ নেই, কিন্তু ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় আছেন, ক্যান্সার স্কিনিংয়ের তাঁদের মধ্য থেকে রোগী শনাক্ত করা।

 

ডক্টর টিভি: স্তন ক্যান্সারের লক্ষণ গুলো বলবেন?

ডা. হাবিবুল্লাহ তালুকদার: সাধারণত পাঁচটি লক্ষণ দেখা যায়।

১. স্তনে চাকা বা পিন্ড।

২. নিপল বা বোঁটা ভেতরে ঢুকে যাওয়া, অসমান বা বাঁকা হয়ে যাওয়া।

৩. নিপল দিয়ে অস্বাভাবিক রস বা রক্তক্ষরণ হওয়া।

৪. চামড়ার রং বা চেহারায় পরিবর্তন।

৫. বগলতায় পিণ্ড বা চাকা।

 

ডক্টর টিভি: স্তন ক্যান্সার স্ক্রিনিং বিষয়ে বলবেন?

ডা. হাবিবুল্লাহ তালুকদার: যাঁদের লক্ষণ দেখা দেয়নি, কিন্তু ক্যান্সার হওয়ার ঝুঁকি বেশি, সহজ কোনো পদ্ধতির মাধ্যমে তাঁদের মধ্য থেকে রোগী খুঁজে বের করার নাম ক্যান্সার স্ক্রিনিং।

ক্যান্সার স্ক্রিনিং করার প্রধান তিনটি পদ্ধতি রয়েছে।

১. ম্যামোগ্রাম বা বিশেষ ধরনের এক্স-রে। যার সাহায্যে স্তনে অস্বাভাবিক পরিবর্তন ধরা পড়ে।

২. ক্লিনিক্যাল ব্রেস্ট এক্সামিনেশন (CBE) বা চিকিৎসক দিয়ে স্তন পরীক্ষা।

৩. ব্রেস্ট সেলফ এক্সামিনেশন (BSE) বা নিজে নিজের স্তন পরীক্ষা।

 

ম্যামোগ্রাম

উন্নত দেশগুলোতে স্তন ক্যান্সার স্ক্রিনিংয়ে প্রধানত ম্যামোগ্রাম বেছে নেওয়া হয়। সাধারণত ৫০ বছরের বেশি বয়সী নারীদের এক, দুই বা তিন বছর পরপর নিয়মিতভাবে ম্যামোগ্রাম করা হয়। এটি একটি বিশেষ ধরনের এক্স-রে, যার মাধ্যমে স্তনে খুব ছোট চাকা বা অন্যান্য অস্বাভাবিক পরিবর্তন ধরা পড়ে।

এই পদ্ধতি তুলনামূলক ভাবে ব্যয়বহুল এবং খুব সহজলভ্য নয় বলে উন্নয়নশীল দেশে অন্য পদ্ধতিগুলোর ওপর জোর দেওয়া হয়।

ক্লিনিক্যাল ব্রেস্ট এক্সামিনেশন

চিকিৎসক অথবা প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত স্বাস্থ্য কর্মী দিয়ে স্তন পরীক্ষা। চিকিৎসক স্তন এবং বগলতলায় কোন চাকা বা অস্বাভাবিক পরিবর্তন আছে কিনা তা সুনির্দিষ্ট নিয়মে পরীক্ষা করে দেখবেন।

 

ডক্টর টিভি: কিভাবে নারী নিজে নিজের স্তন পরীক্ষা করবেন?

ডা. হাবিবুল্লাহ তালুকদার: একজন মহিলা নির্দিষ্ট পদ্ধতিতে নিজেই নিজের স্তন পরীক্ষা করবেন। মাসের একটি নির্দিষ্ট দিনে যদি নিয়মিতভাবে নিজের স্তন ভালোভাবে পরীক্ষা করেন, তাহলে যে কোন ধরনের অসামাঞ্জস্য ও পরিবর্তন নিজেই প্রাথমিকভাবে চিহ্নিত করতে পারবেন।

 

ডক্টর টিভি: স্তন ক্যান্সার স্ক্রিনিংয়ে কি ধরণের সুপারিশ করা হয়?

ডা. হাবিবুল্লাহ তালুকদার: ২০ বছর বয়স থেকে সারা জীবন প্রতি মাসে একবার নিজের স্তন পরিক্ষা করুন। অস্বাভাবিক কোনো পরিবর্তন আপনার কাছে ধরা পড়লে চিকিৎসক অথবা প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত স্বাস্থ্যকর্মী দিয়ে স্তন পরীক্ষা করুন। চিকিৎসক যদি কোনো চাকা বা পিন্ড অথবা অন্য কোনো অস্বাভাবিক পরিবর্তন শনাক্ত করেন, তবে পরামর্শমতো ম্যামোগ্রাম, স্তনের আল্ট্রাসনোগ্রাম অথবা অন্যান্য পরীক্ষা করান।

মনে রাখবেন, প্রাথমিক পর্যায়ে ধরা পড়লে স্তন ক্যান্সার নিরাময়ের সম্ভাবনা প্রায় শতভাগ।

 

ডক্টর টিভি: আপনার গুরুত্বপূর্ণ সময় দেওয়ার জন্য ডক্টর টিভির পক্ষ থেকে অসংখ্য ধন্যবাদ।

ডা. হাবিবুল্লাহ তালুকদার: আপনাকে ও ডক্টর টিভিকে ধন্যবাদ।


আরও দেখুন: