শহীদ বাবার সম্মানে বিনাপারিশ্রমিকে ১০০১ কিডনি প্রতিস্থাপন
পরিবারের সদস্যদের সাথে হাসিমুখে ১০০১ কিডনি প্রতিস্থাপনকারী অধ্যাপক ডা. কামরুল ইসলাম
মুক্তিযুদ্ধের শহীদ বাবার সম্মানে বিনাপারিশ্রমিকে এক হাজার একটি কিডনি প্রতিস্থাপন, ফ্রি মাসিক ফলোআপ! এ কর্মযজ্ঞ আমাদের ঢাকা মেডিকেল কলেজ ব্যাচ কে-৪০- এর ফার্স্ট বয় কামরুলের।
অধ্যাপক ডা. কামরুল ইসলাম, এমবিবিএস (ডিএমসি), এফসিপিএস (সার্জারি), এফআরসিএস (এডিন), এমএস (ইউরোলজি)। স্বাধীনতা যুদ্ধে শহীদ পাকশী ইক্ষু গবেষণা ইনস্টিটিউটের কৃষিবিদ বাবা আমিনুল ইসলামের চার ছেলের মধ্যে দ্বিতীয় কামরুল। সে পাকশীর চন্দ্রপ্রভা বিদ্যাপীঠ থেকে ১৯৮০ সালে এসএসসিতে মেধা তালিকায় ১৫তম স্থান অর্জন করে ঢাকা কলেজে ভর্তি হয় এবং এইচএসসি পরীক্ষায় ১০ম স্থান অর্জন করে। ১৯৮২ সালে তখনকার আটটি মেডিকেল কলেজের সমন্বিত ভর্তি পরীক্ষায় প্রথম হয়। ১৯৮৩ সালের ৬ এপ্রিল আমরা ঢাকা মেডিকেল কলেজে এক সাথে ক্লাস শুরু করি।
তার বাবার অপরাধ ছিল মুক্তিযোদ্ধারা তাদের বাসায় রাতে মিলিত হতেন। ফলশ্রুতিতে একরাতে বিহারি ও রাজাকাররা এসে তার বাবাকে হত্যা করে। শহীদ বাবার সম্মানে স্বাধীনতার পর ঈশ্বরদীর সেই এলাকার নামকরণ হয় আমিনপাড়া। স্বামীহারা এসএসসি পাস মা চার ছেলেকে মানুষ ও নিজের পায়ে দাঁড়ানোর জন্য আবার পড়াশুনা শুরু করেন। এইচএসসি পাস করে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হন এবং সমাজবিজ্ঞানে প্রথম স্থান অর্জনের পর মাস্টার্স করেন। ১৯৮১ সালে খালাম্মা অধ্যাপিকা রহিমা খাতুন ঢাকার লালমাটিয়া মহিলা কলেজে যোগদান করেন।
আমরা ঢাকা মেডিকেল থেকে ১৯৮৯ সালে পাস করে ইন্টার্নশিপ শেষ করি ১৯৯০ সালে। পরে একাদশ বিসিএসে ১৯৯৩ সালের ১ এপ্রিল স্বাস্থ্য ক্যাডারে যোগদান করি। কামরুল ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ট্রেনিং পদে যোগ দেয় এবং সার্জারিতে এফসিপিএস ও এডিনবরা রয়েল কলেজ থেকে এফআরসিএস পাস করে। পরে ইউরোলজিতে পাঁচ বছর মেয়াদি এমএস প্রোগ্রাম সম্পন্ন করে এবং জাতীয় কিডনি ও ইউরোলজি (এনআইকেডিইউ) হাসপাতালে সহকারী অধ্যাপক হিসেবে যোগদান করে।
২০০৭ সালে সফলভাবে কিডনি প্রতিস্থাপন (ট্রান্সপ্লান্ট) শুরু করে। পরে আমাদের বন্ধু কামরুল সরকারি হাসপাতালে কাজের বিভিন্ন সীমাবদ্ধতার কারণে ২০১১ সালে চাকরি থেকে ইস্তফা দেন এবং শ্যামলীতে স্বল্পমূল্যে কিডনি রোগীদের সেবা দেওয়ার জন্য নিজস্ব কিডনি হাসপাতাল প্রতিষ্ঠা করে। সেন্টার ফর কিডনি ডিজিজেস অ্যান্ড ইউরোলজি বা সংক্ষেপে সিকেডি অ্যান্ড ইউরোলজি— লালের মধ্যে সাদা নিয়ন সাইন রাস্তার পাশে যে কারও চোখে পড়ে।
কামরুল তার শহীদ বাবার সম্মানে কিডনি প্রতিস্থাপন করার জন্য কোনো পারিশ্রমিক নেয় না। প্রতিবেশী দেশেও যেখানে ২৫-৩০ লাখ টাকা খরচ হয়, সেখানে কামরুলের হাসপাতালে খরচ মাত্র ২ লাখ ১০ হাজার টাকা! এটা বাদে তার ১২ সদস্যের টিমের সদস্যদের আর ওষুধপত্র ও অপারেশনের আনুসঙ্গিক খরচ, থাকা-খাওয়া!
কিডনি ডোনারের শরীর থেকে নিয়ে গ্রহীতার শরীরে প্রতিস্থাপনের আগে যে কম মূল্যের প্রিজারভেটিভ সল্যুশনে রাখে, তাও তার আবিষ্কার এবং এজন্য ইউরোলজিস্টদের জাতীয় সংগঠন বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব ইউরোলজিক্যাল সার্জনস তাকে স্বর্ণ পদক দিয়ে যথার্থ সম্মান জানায়।
কামরুলের হাসপাতালে প্রতিদিন প্রায় ১০০ রোগী তার সেবা নিতে আসেন এবং খুবই কম মূল্যে সার্জারিসহ সেবা পান। আমাকে একবার এক ছোট ভাই ইউরোলজিস্ট বললো, টাবলু ভাই আপনার বন্ধুর জন্য তো আমরা প্রাকটিস করতে পারব না। আমি জিজ্ঞেস করলাম কেন কি হয়েছে? সে বললো, কামরুল ভাই তো নামমাত্র খুবই স্বল্পখরচে প্রস্টেটসহ (Prostate) অন্যান্য অপারেশন করেন! ওর হাসপাতালের ২২ বেডের ডায়ালাইসিস ইউনিটে ডায়ালাইসিসের খরচ মাত্র ১ হাজার ৫০০ টাকা। আইসিইউ শয্যার খরচ ৭ হাজার থেকে ৯ হাজার টাকা!
আমাদের সদা হাস্যময় অসম্ভব বিনয়ী বন্ধু কামরুলকে তার মা, ভাই, বউ, তিন কন্যাসহ পরম করুনাময় ভালো রাখুন, সুস্থ রাখুন, দীর্ঘদিন মানুষের সেবা দেওয়ার সুযোগ দিন। নিশ্চয় জাতি নিভৃতচারী এই গুণী শিক্ষক ও সার্জনকে যথোপযুক্ত সম্মান জানাতে কার্পণ্য করবে না বলেই আমাদের বিশ্বাস।