নোবেল জয়ী আলোচিত চিকিৎসাবিজ্ঞানীদের গল্প
(বাঁ থেকে ঘড়ির কাঁটা অনুসারে) এমিল ফন বেরিং, রোনাল্ড রস, নিল্স র্যুবের্গ ফিনসেন, ইভান পাভলভ, সান্তিয়াগো রামোন ই কাহাল হাইনরিখ ক্যামিলো গলজি ও হের্মান রবার্ট কখ।
চিকিৎসাবিদ্যায় বিশেষ অবদানের জন্য প্রতিবছর চিকিৎসাবিজ্ঞানে নোবেল পুরস্কার দেওয়া হয়। ১৮৯৫ সালে সুইডেনের বিজ্ঞানী আলফ্রেড নোবেল যে পাঁচটি ক্ষেত্রে পুরস্কার প্রদানের ব্যাপারে দলিলে উল্লেখ করে গিয়েছিলেন তার মধ্যে এটি অন্যতম। ১৯০১ সাল থেকে নিয়মিত এ পুরস্কারটি দেওয়া হচ্ছে।
চিকিৎসা বিজ্ঞানের নোবেল পদক
চিকিৎসা বিজ্ঞানে নোবেল পদকটি অন্য পদকের চেয়ে একটু আলাদা। প্রদত্ত মেডেলের সম্মুখ দিকে থাকে আলফ্রেদ নোবেলের খোদিত ছবি যা পদার্থবিজ্ঞান, রসায়ন বা সাহিত্যের জন্য প্রদত্ত মেডেলের মতই। তবে অন্য পাশটা আলাদা। সেই পাশে মেধাবী এক চিকিৎসকের প্রতিকৃতি দেখা যায়, যে নিজের কোলে রাখা একটি উন্মুক্ত বই ধরে আছে। আর একই সাথে পাথরের বুক চিড়ে প্রবহমান পানি দিয়ে একটি মেয়ে তৃষ্ণা মেটানোর চেষ্টা করছে।
পৃথিবীর ইতিহাসে চিকিৎসা বিজ্ঞানে অবদানের জন্য নোবেল বিজয়ীদের সম্পর্কে আসুন জেনে নিই-
এমিল ফন বেরিং: বিশ্বের ইতিহাসে প্রথমবারের মতো (১৯০১ সালে) চিকিৎসাবিদ্যায় নোবেল জয় করেন জার্মান জীববিজ্ঞানী এমিল ফন বেরিং। তিনি ডিপথেরিয়া রোগের বিরুদ্ধে কার্যকর সিরাম থেরাপি বিষয়ে গবেষণার জন্য মর্যাদাবান এ পুরস্কার পাওয়ার গৌরব অর্জন করেন।
রোনাল্ড রস: ম্যালেরিয়া জীবাণু নিয়ে গবেষণায় সাফল্য দেখিয়ে নোবেল জয় করে নেন ইংল্যান্ডের এ বিজ্ঞানী। তিনি ম্যালেরিয়া জীবাণু কী করে মানব শরীরে প্রবেশ করে তা নিয়ে গবেষণার জন্য ১৯০২ সালে এ পুরস্কারের জন্য নির্বাচিত হন।
নিল্স র্যুবের্গ ফিনসেন: নিল্স র্যুবের্গ ফিনসেন একজন আইসল্যান্ডীয় বংশোদ্ভূত ডেনমার্কের চিকিৎসক ও বিজ্ঞানী। তিনি লুপাস ভালগারিস রোগের চিকিৎসায় অবদানের স্বীকৃতি হিসেবে ১৯০৩ সালে চিকিৎসাবিজ্ঞানে নোবেল পুরস্কার লাভ করেন। ১৯০৪ সালের সেপ্টেম্বর মাসে ডেনমার্কের এ বিজ্ঞানী মৃত্যুবরণ করেন।
ইভান পাভলভ: রাশিয়ার একজন প্রসিদ্ধ চিকিৎসক ও গবেষক ইভান পেত্রোভিচ পাভলভ পৌষ্টিক ক্রিয়ার শরীর তত্ত্বের ওপর গবেষণার জন্য তিনি নোবেল পুরস্কার পান। তিনি ১৯০৪ সালে নোবেল পুরস্কার লাভ করেন।
তার সবচেয়ে বড় অবদান "সাপেক্ষ প্রতিবর্ত" ব্যাখ্যাকারী গবেষণাসমূহ। তিনি গুরুমস্তিষ্কের অনেকগুলি প্রতিবর্ত ক্রিয়ার ব্যাখ্যা প্রদান করেন, এবং গবেষণার মাধ্যমে কুকুরের দেহে কিভাবে এই সব প্রতিবর্ত তৈরি হয় ও কাজ করে তা প্রমাণ করেন। ১৯২২ সালে তার ফলাফলগুলি ভাষণ আকারে প্রকাশিত হয়।
১৯৩৬ সালের ফেব্রুয়ারিতে তিনি মারা যান।
হাইনরিখ হের্মান রবার্ট কখ: ১৯০৫ সালে নোবেল পদক পান জার্মান চিকিৎসক ও চিকিৎসাবিজ্ঞানী হাইনরিখ হের্মান রবার্ট কখ। যক্ষ্মা নিয়ে গবেষণা করার জন্য তিনি এ সম্মানে ভূষিত হন।
পরীক্ষাগারে অনেক শ্রম ও যত্ন সহকারে গবেষণাকর্ম সম্পাদন করে অণুজীব-সংক্রান্ত অধ্যয়ন ও গবেষণাকে আধুনিক ব্যাকটেরিয়া বিজ্ঞানে উন্নীত করেন ডা. হের্মান রবার্ট কখ।
১৮৭০-এর দশকে তিনি অ্যানথ্রাক্স রোগের ওপরে গবেষণা শুরু করেন। অ্যানথ্রাক্স ছিল উষ্ণ-রক্তের প্রাণীদের জন্য একটি প্রাণঘাতী রোগ। তিনি অ্যানথ্রাক্সের অনেকগুলি জীবাণু শনাক্ত ও আলাদা করেন এবং এগুলির বেশ কিছু ভিন্ন ভিন্ন ফলন তৈরি করেন।
এরপর ওই ফলানো জীবাণুগুলি দিয়ে তিনি সুস্থ প্রাণীর (ইঁদুরের) দেহে সংক্রমণ ঘটান এবং দেখানোর চেষ্টা করেন কোন্ জীবাণু কোন ধরনের সংক্রমণ ঘটায়।
তিনি প্রমাণ করে দেখান যে অ্যানথ্রাক্স ব্যাসিলাস নামের ব্যাকটেরিয়ার জীবন্ত দণ্ড বা রেণুবিশিষ্ট পদার্থ যখন সুস্থ ইঁদুরের রক্তে সূচিপ্রয়োগ করে প্রবেশ করানো হয়, তখন সেই সুস্থ ইঁদুরের দেহেও অ্যানথ্রাক্স রোগ সৃষ্টি হয়।
তিনি পোল্যান্ডের ব্রেসলাউ বিশ্ববিদ্যালয়ের বিজ্ঞানীদের কাছে তার গবেষণার ফলাফল পেশ করেন। এভাবে তিনি বিশ্বের ইতিহাসে প্রথমবারের মত সন্দেহাতীতভাবে ও নিশ্চিতভাবে প্রমাণ করতে সক্ষম হন যে একটি নির্দিষ্ট জীবাণু একটি নির্দিষ্ট রোগ সৃষ্টির জন্য দায়ী।
১৮৮১ সালে তিনি যক্ষ্মারোগের উপরে গবেষণা শুরু করেন। এর পরের বছরেই অর্থাৎ ১৮৮২ সালে তিনি যক্ষ্মা রোগ সৃষ্টিকারী জীবাণু তথা ব্যাকটেরিয়াটি (টিউবার্কল ব্যাসিলাস) আলাদা করতে সক্ষম হন এবং এটিকে রোগটির কারণ হিসেবে প্রমাণ করে দেখান। সারা বিশ্বজুড়ে গবেষকরা কখের এই আবিষ্কার সঠিক বলে নিশ্চিত করেন। এই আবিষ্কারের পরে সংক্রামক রোগনির্ণয় পদ্ধতিতে উন্নয়ন সাধিত হয় এবং দেহজ নিঃসরণ বিশেষ করে কফের থুতুতে ব্যাসিলার ব্যাকটেরিয়ার উপস্থিতি প্রমাণ করার পরীক্ষা চালু হয়।
১৮৮৩ সালে কখ মিশরে ও ভারতে স্থানীয়ভাবে মহামারী পর্যায়ে চলে যাওয়া কলেরা বা ওলাওঠা রোগ নিয়ে গবেষণা করার লক্ষ্যে গঠিত একটি কমিশনের প্রধান নির্বাচিত হন। ঐ বছরই তিনি কলেরা সৃষ্টিকারী ব্যাসিলাস ব্যাকটেরিয়া ধরনের জীবাণুটি আবিষ্কারের ঘোষণা দেন।
তিনি দেখান যে ব্যাকটেরিয়াটি মূলত পানির মাধ্যমে বাহিত হয়ে কলেরা রোগের সংবহন ঘটায়। এছাড়া রিন্ডারপেস্ট নামক গবাদি পশুর সংক্রামক মহামারী রোগের জন্য টিকা প্রস্তত করেন।
ফলে জার্মানিতে তার ভূয়সী প্রশংসা করা হয়। তাকে ২৫ হাজার মার্কিন ডলারের সমতুল্য অর্থ দেওয়া হয় এবং গবেষণাকর্ম চালিয়ে যাওয়ার জন্য ১৮৯১ সালে তাকে বার্লিনের একটি বৃহৎ উচ্চতর গবেষণা কেন্দ্রের পরিচালক হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয়, যার নাম ছিল সংক্রামক ব্যাধিসমূহের উচ্চতর গবেষণা কেন্দ্র। বর্তমানে এটিকে রোবের্ট কখ উচ্চতর গবেষণা কেন্দ্র নামকরণ করা হয়েছে।
১৮৯০ সালে তিনি টিউবারকুলিন নামের একটি পদার্থ আবিষ্কার করেন; পদার্থটিকে শুরুতে ত্রুটিবশত যক্ষ্মার একটি প্রতিকারমূলক ঔষধ হিসেবে গণ্য করা হলেও বর্তমানে এটিকে যক্ষ্মার উপস্থিতি শনাক্ত করতে ব্যবহৃত হয়। এরপর কখ পূর্ব আফ্রিকা ও পশ্চিম আফ্রিকার কীটপতঙ্গ-বাহিত গ্রীষ্মমণ্ডলীয় রোগব্যাধিগুলি নিয়ে গবেষণা করা শুরু করেন।
১৯০৪ সালে অবসর গ্রহণের আগ পর্যন্ত কখ সেখানে কর্মরত ছিলেন। কখ ১৯০৫ সালে তার কাজের জন্য চিকিৎসাবিজ্ঞানে নোবেল পুরস্কার অর্জন করেন।
কখ ১৯১০ খ্রিস্টাব্দের ২৭শে মে তারিখে জার্মানির স্বাস্থ্যোদ্ধারমূলক কেন্দ্র বাডেন-বাডেন শহরে মৃত্যুবরণ করেন।