করোনাকালে ডেঙ্গু ও করণীয়
শরীরে ব্যথা থাকলেও অ্যাসপিরিন বা অন্য ব্যথানাশক ওষুধ একেবারেই সেবন করা যাবে না
বিশ্বে প্রতি বছর ৫০ মিলিয়ন মানুষ ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়। এদের মধ্যে ২৫ হাজারের বেশি মানুষ মারা যায়। ১৯৬০ থেকে ২০০৯ সালের মধ্যে ডেঙ্গু আক্রান্তের সংখ্যা ৩০ ভাগ বেড়েছে।
বাংলাদেশে ডেঙ্গু জ্বরে আক্রান্ত হওয়ার কথা ব্যাপকভাবে জানা যায় ২০০০ সালে। সে সময় এটি আতঙ্কের কারণ হয়ে দাঁড়ায়। এরপর খুব বেশি আক্রান্তের খবর পাওয়া না গেলেও ২০১৮-১৯ সালে দেশে এটি মহামারি আকারে ছড়িয়ে পড়ে। গত বছর দেশে করোনা ছড়িয়ে পড়লে ডেঙ্গু দেখা যায়নি। কিন্তু চলতি বছর ব্যাপকহারে ছড়িয়ে পড়েছে ডেঙ্গু। করোনাকালে ডেঙ্গু ছড়িয়ে পড়ায় দেখা দিয়েছে নানা সমস্যা। হাসপাতাল এমনিতেই করোনার রোগী ভর্তি, এমন অবস্থায় ডেঙ্গু রোগী ভর্তি দিন দিন বেড়েই চলছে।
করোনা ও ডেঙ্গু— দুটি রোগের লক্ষণ বেশ কাছাকাছি। জ্বর থাকে দুটিতেই। সর্দি, কাশি, শ্বাসকষ্ট বেশি থাকে করোনাতে। ডেঙ্গুতে সাধারণত চোখের পেছনে ব্যথা করে বেশি। তবে মাথাব্যথাও থাকতে পারে। ডায়রিয়া করোনাতে বেশি হয়। শরীরে র্যাশ ডেঙ্গুতে থাকে সাধারণত। তারপরও দুটি আলাদা করার জন্য পরীক্ষার প্রয়োজন পড়ে। আজকে আমাদের আলোচনার বিষয় ডেঙ্গু জ্বর-
কীভাবে ছড়ায় ডেঙ্গু
ডেঙ্গু একটি ভাইরাসজনিত রোগ। এটি মশার কামড়ের মাধ্যমে ছড়ায়। আক্রান্ত ব্যক্তিকে এডিস মশা কামড়ালে ডেঙ্গু ভাইরাস রক্তের সাথে মশার দেহে চলে যায়। মশার শরীরে এ ভাইরাস বংশবৃদ্ধি করে। ৮-১০ দিন পর ওই মশা অন্য কাউকে কামড়ালে তার শরীরে ভাইরাসটি ঢুকে সেও আক্রান্ত হয়।
ডেঙ্গুর লক্ষণ
ডেঙ্গু যেহেতু ভাইরাসজনিত জ্বর, সেহেতু এর লক্ষণও ভাইরাস জ্বরের মতোই। হঠাৎ করেই প্রচণ্ড জ্বরে (১০৩-১০৪ ডিগ্রি) আক্রান্ত হন। সাথে থাকে মাথাব্যথা, শরীর ব্যথা, জয়েন্টে ব্যথা, চোখের নিচে ব্যথা (চোখ নড়ালে ব্যথা অনুভূত হয়)। শরীরে বা জয়েন্টে বেশি ব্যথা হয় বলে এ জ্বরের অন্য নাম ব্রেক বোন ফিভার। জ্বরের সাথে শরীরে র্যাশ বা লালচে ভাব দেখা দেয়। সাধারণত জ্বরের দ্বিতীয় দিন থেকে ত্বক লালচে ভাব ধারণ করে। আমাদের ত্বকে র্যাশ এত ভালো বোঝা যায় না। জ্বর সাধারণত ২-৭ দিন পর কমে যায়। জ্বর কমা মানেই কিন্তু রোগ মুক্তি নয় বরং তা মারাত্মক আকার ধারণ করতে পারে।
জ্বর কমার ২-৩ দিন পরের সময় বেশি মারাত্মক। এ সময় জটিলতা দেখা দেয়। রক্তে অণুচক্রিকা কমে গেলে রক্তক্ষরণ শুরু হয়। এ সময়টাতে বেশি সচেতন থাকতে হয়। আক্রান্ত ব্যক্তি বার বার বমি বা রক্তবমি করতে পারে, পেটে প্রচণ্ড ব্যথা অনুভূত হতে পারে, নাক দিয়ে রক্ত পড়তে পারে, মাড়ি থেকে রক্তপাত হতে পারে, চোখে রক্তজমাট বাঁধতে পারে। এ ছাড়া শরীরের ভেতরে রক্তক্ষরণ হতে পারে। এক্ষেত্রে প্রচণ্ড পেটে ব্যথা, আলকাতরার মতো কালো দুর্গন্ধযুক্ত মল হতে পারে, মল ও প্রসাবের সাথে রক্ত পড়তে পারে। একেই বলে ডেঙ্গু হেমোরোজিক ফিভার।
এ ধরনের লক্ষণ দেখা দিলে দেরি না করে আক্রান্ত ব্যক্তিকে হাসপাতালে ভর্তি করতে হবে। চিকিৎসা শুরু করতে দেরি করলে আক্রান্ত ব্যক্তি শকে চলে যেতে পারে। সেক্ষেত্রে রোগীর হাত-পা ঠান্ডা হয়ে যায়, নাড়ির গতি ও রক্তচাপ কমে যায়। আক্রান্ত ব্যক্তি অজ্ঞান হতে পারে এমনকি মৃত্যুর মুখে পতিত হতে পারে।
প্রতিবছর ৫ লাখ মানুষ ডেঙ্গু হেমোরেজিক ফিভারে আক্রান্ত হলেও মারা যান ২ দশমিক ৫ ভাগ মাত্র। সঠিক সময়ে চিকিৎসা করালে এ মৃত্যু রোধ করা সম্ভব। চিকিৎসা শুরু করতে দেরি হলে মৃত্যুহার ২০ শতাংশ হতে পারে।
ডেঙ্গু জ্বরের চিকিৎসা
ডেঙ্গু জ্বরের চিকিৎসা সাধারণ জ্বরের মতোই। বিশ্রাম নিতে হবে। জ্বরের জন্য প্যারাসিটামল সেবন করতে হবে। তবে দিনে ৪ বারের বেশি নয়। জ্বর কমানোর জন্য বার বার পানি দিয়ে শরীর মুছে বা স্পঞ্জিং করে দিতে হবে। জ্বরে পানিশূন্যতা দেখা দেয়। এজন্য প্রচুর পরিমাণে পানি ও পানীয় যেমন ওরাল স্যালাইন, ফলের জুস, শরবত পান করতে হবে। তবে প্যাকেটজাত জুস পান না করাই শ্রেয়। অ্যান্টিবায়োটিক সেবন করবেন না। শরীরে ব্যথা থাকলেও অ্যাসপিরিন বা অন্য ব্যথানাশক ওষুধ একেবারেই সেবন করা যাবে না।
ডেঙ্গু হেমোরেজিক ফিভারে আক্রান্ত হলে হাসপাতালে ভর্তি করে চিকিৎসার ব্যবস্থা করতে হবে। এ ধরনের রোগীদের ইনজেকশন দেওয়া যাবে না। এ ধরনের রোগীরও প্রচুর পরিমাণে পানি পান করতে হবে। বমির কারণে অনেকে পানি পান করতে পারেন না। তাদের ক্ষেত্রে শিরা পথে স্যালাইন দিতে হয়। ডেঙ্গু আক্রান্ত সব রোগীকেই কিন্তু রক্ত দেওয়ার প্রয়োজন পড়ে না। রক্তের প্লাটিলেটের পরিমাণ ১০ হাজারের কম ও শরীরে রক্তক্ষরণ হলে প্লাটিলেট কনসেন্ট্রেশন দেওয়ার প্রয়োজন হয়।
হিমোগ্লোবিন ৫ গ্রাম/ডেসিলিটারের কম, শিরার মাধ্যমে স্যালাইন দেওয়া হলেও অবস্থার অবনতি ঘটে, হেমাটোক্রিটের মাত্রা ভালো থাকে। তবে হোল ব্লাড দেওয়া যেতে পারে। হোল ব্লাড দিলে হেমোকসসেন্ট্রেশন হয়ে রোগীর অবস্থা খারাপের দিকে যেতে পারে। তাই প্রয়োজন না থাকলে হোল ব্লাড দেওয়া ঠিক নয়। সিরাম অ্যালবুমিন ২ গ্রাম/ডেসিলিটারের কম হলে, আক্রান্ত ব্যক্তি শকে গেলে প্লাজমা বা প্লাজমা সাবস্টিটিউ দিতে হয়। রক্তে প্লাটিলেট কাউন্ট ৫০ হাজারের নিচে নামা শুরু করলে রক্ত সংগ্রহে রক্তদাতাদের ঠিক করুন।
প্রতিরোধে সর্বোত্তম চিকিৎসা
প্রথম পদক্ষেপ হিসেবে নিজের ঘর ও আঙিনায় মশার উৎস ধ্বংস করুন। এডিস মশার বৈশিষ্ট্য হলো, এরা পরিষ্কার জমা হওয়া পানিতে বংশবিস্তার করে। বর্ষাকালে বৃষ্টির পানি জমে গেলে সে পানিতে এরা বংশবিস্তার করে। প্লাস্টিকের পাত্র, পুরোনো ক্যান বা পাত্র, গামলা, টায়ার, ডাবের খোসা, গাছের কোটরে, ফুলের টবে, ছোট আবদ্ধ জায়গায় যাতে বৃষ্টির পানি জমে না থাকে সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে। সুইমিং পুলের পানি প্রতিদিন পরিবর্তন করতে হবে। কারও অপেক্ষা না করে নিজ উদ্যোগে বাড়ির আশপাশের পরিবেশ পরিচ্ছন্ন রাখুন।
সাধারণত ভোরে সূর্যোদয়ের আধা ঘণ্টার মধ্যে এবং সন্ধ্যায় সূর্যাস্তের আধা ঘণ্টা আগে এডিস মশা কামড়াতে পছন্দ করে। তাই এই দুই সময়ে মশার কামড় থেকে সাবধান থাকতে হবে। মশার কামড় থেকে রক্ষা পেতে মশারি ব্যবহার করুন। আক্রান্ত ব্যক্তিকে মশা যেন কামড়াতে না পারে সেজন্য মশারি ব্যবহার করুন। কোথাও ডেঙ্গুতে আক্রান্ত রোগীর সন্ধান পেলে আশপাশের সবাইকে তা জানান এবং আতঙ্কিত না হয়ে সচেতন হোন।