লিভার ক্যানসারে মৃত্যুতে দায়ী হেপাটাইটিস বি ও সি
এশিয়া বিশেষ করে বাংলাদেশে এটি লিভার ক্যানসারের প্রধান কারণ হিসেবে দেখা দিয়েছে
আজ বুধবার বিশ্ব হেপাটাইটিস দিবস। হেপাটাইটিস বি ভাইরাস শনাক্ত ও এটি প্রতিরোধের টিকা আবিষ্কার করেন যুক্তরাষ্ট্রের নোবেল বিজয়ী চিকিৎসা বিজ্ঞানী অধ্যাপক ব্রয়েলশ ব্লুমবার্গ। ২০১০ সাল থেকে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (ডাব্লিউএইচও) উদ্যোগে প্রতি বছর তার জন্মদিনে দিবসটি পালিত হয়।
আমরা জানি, হেপাটাইটিস বি ভাইরাসের ভ্যাকসিন হলো প্রথম টিকা যার মাধ্যমে ক্যানসার প্রতিরোধ করা হচ্ছে। হেপাটাইটিস বি ভাইরাস লিভার ক্যানসারের অন্যতম বড় কারণ। এশিয়া বিশেষ করে বাংলাদেশে এটি লিভার ক্যানসারের প্রধান কারণ হিসেবে দেখা দিয়েছে।
প্রতি বছর আমাদের দেশে হেপাটাইটিস বি এবং সি ভাইরাসজনিত লিভার সিরোসিস ও লিভার ক্যানসারে প্রায় ২০ হাজার মানুষ মারা যাচ্ছে। অত্যন্ত দুঃখের বিষয়, গত দেড় বছর দেশে করোনায় যত মৃত্যু হয়নি, লিভারের অসুখে তার চেয়ে বেশি মানুষ মারা গেছে।
পৃথিবীর বেশিরভাগ দেশের বাস্তবতাও এমন। এমন প্রেক্ষাপটেই হয়েছিল টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা ৩.৩। আর এর লক্ষ্য হলো, ২০৩০ সালের মধ্যে হেপাটাইটিস বি এবং সি ভাইরাস নির্মূল করা। কাজটি বলা সহজ হলেও করা কঠিন। কারণ পৃথিবীর বেশিরভাগ মানুষ হেপাটাইটিস বি বা সি ভাইরাসে আক্রান্ত কি না তা জানেই না।
২০৩০ সালের মধ্যে হেপাটাইটিস বি ও সি ভাইরাস নির্মূলে করণীয়
প্রথমেই মানুষকে সচেতন করতে হবে। তাদের বোঝাতে হবে, পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে রোগ নির্ণয় জরুরি। পরীক্ষার পর যাদের শরীরে বি বা সি ভাইরাস রয়েছে, তাদের চিকিৎসার আওতায় আনতে হবে। রোগীর সংখ্যা বাড়লে সে অনুযায়ী চিকিৎসাসেবার মান বাড়াতে হবে। পরিষেবার আওতা বৃদ্ধি করা প্রয়োজন। পাশাপাশি বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক তৈরি করতে হবে। সাশ্রয়ী মূল্যে ওষুধ প্রস্তুত করতে হবে। কারণ দীর্ঘদিন ওষুধ খাওয়া লাগে। সবার তো দামি ওষুধ কিনে খাওয়ার সামর্থ থাকে না।
সবার তো লিভার ক্রনিক হেপাটাইটিস থাকে না। কারও কারও লিভার সিরোসিস বা লিভার ক্যানসার থাকতে পারে। তাদের জন্য সেই মানের উন্নত হাসপাতাল তৈরি করতে হবে। লিভার বিশেষজ্ঞ তৈরিতে কাজ করছে মাত্র বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়, ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজ এবং বিসিপিএস। এখন নতুন নতুন জায়গায় এ কোর্সগুলো চালু করতে হবে।
যেভাবে বিশাল চ্যালেঞ্জ অতিক্রম করতে হবে
আমাদের হাতে সময় কম। ২০৩০ সালের মধ্যে লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করতে হবে। গুরুত্বপূর্ণ হলো করোনা মহামারীর মধ্যে অন্যান্য স্বাস্থ্যসেবা বা বি ভাইরাসের ভ্যাকসিন কার্যক্রম মারাত্মকভাবে ব্যাহত হচ্ছে। ফলে আমরা কিছুটা হলেও পিছিয়ে পড়েছি। এ অবস্থায় দাঁড়িয়ে লক্ষ্য অর্জনে মানুষকে সচেতন করার কোনো বিকল্প নেই। আমাদের যারা বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক রয়েছেন, সরকার, এনজিও সবাইকে নিয়ে কাজ করতে হয়।
প্রয়োজনে গ্রামের চিকিৎসক, জেনারেল ফিজিশিয়ান ও মেডিসিন বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকদের সাথে নিয়ে কাজ করতে হবে, শুধু গুটিকয়েক লিভার বিশেষজ্ঞদের নিয়ে হেপাটাইটিস নির্মূল করা সম্ভব নয়। গোটা বিষয় নির্মূলে আমাদের এমন একটি রেফারেল সিস্টেম চালু করতে হবে, যেখানে একজন রোগীকে এমবিবিএস চিকিৎসক দেখলেই বুঝবেন তিনি লিভার রোগে আক্রান্ত। সাথে সাথে তিনি তাকে লিভার বিশেষজ্ঞের কাছে পাঠিয়ে দিবেন। যদিও এটি অত্যন্ত চ্যালেঞ্জিং কাজ।
২০৩০ সাল আসতে বাকি ৯ বছর। এই কয়েক বছরের মধ্যে এটি নির্মূল করা আমাদের জন্য অত্যন্ত চ্যালেঞ্জিং। তবে আগে স্বাস্থ্য বিষয়ে আমাদের অনেক অর্জন রয়েছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ২০১৯ সালে বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দিয়েছে। আমরা পাঁচ বছরের কম বয়সীদের মধ্যে হেপাটাইটিস বি প্রাদুর্ভাবটি ১ শতাংশের নিচে আনতে পেরেছি। এটি মূলত টিকার মাধ্যমে সম্ভব হয়েছে। হেপাটলজিস্টদের একটি স্বতন্ত্র নীতিমালা করা সম্ভব হয়েছে। ফলে এখন অনেক লিভার বিশেষজ্ঞ তৈরি হচ্ছে। সবচেয়ে বড় অর্জন হলো, হেপাটাইটিস বি ও সি এবং লিভার সিরোসিস ও লিভার ক্যানসারের মতো রোগের ওষুধ দেশেই উৎপাদন হচ্ছে।
আমাদের দেশে এখন লিভার ক্যানসার রোগীদের লিভার ট্রান্সপ্লান্ট, স্টেম সেল থেরাপি, প্লাজমা এক্সচেঞ্জ, লিভার ফেইলিওরসহ অসংখ্য রোগের চিকিৎসা সম্ভব হচ্ছে। এ বছর বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ে একটি ইন্টারভেনশনাল হেপাটোলজি বিভাগ চালু হয়েছে। এটি যে শুধু বঙ্গবন্ধুতে চিকিৎসা হবে তা নয়, এখান থেকে লিভার বিশেষজ্ঞরা উন্নত প্রশিক্ষণ নিয়ে সারা দেশে স্বাস্থ্যসেবা দিতে পারবেন।
সবচেয়ে বড় যে কাজটি হয়েছে, সরকার ভাইরাল হেপাটাইটিস নির্মূলের জন্য অপারেশনাল প্ল্যান (ওপি) অনুমোদন দিয়েছে। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের সংক্রমণ ব্যাধি শাখার আরও কিছু পরিকল্পনা রয়েছে। হেপাটাইটিস নির্মূলে আমাদের প্রস্তুতির জায়গা যথেষ্ট রয়েছে। তবে এটি আরও জোরদার করতে হবে। নতুন আরও কী ধরনের পরিকল্পনা নেয়া যায়, সে বিষয়ে গবেষণা বাড়াতে হবে।