কোরবানির বর্জ্য অপসারণে আছে ব্যক্তি-সরকার উভয়ের ভূমিকা
জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ডা. লেনিন চৌধুরী।
কোরবানির বর্জ্য পরিষ্কার করতে ঈদের আগেই নিজেদের মতো করে ব্যবস্থা নিতে হবে। ব্যক্তি পর্যায়ে বর্জ্য অপসারণের ক্ষেত্রে সচেতনতার পাশাপাশি কিছু পদক্ষেপ নেওয়া জরুরি। যথাসময়ে কোরবানির বর্জ্য অপসারণে করণীয় কী বা না করলে কী হতে পারে- ডক্টর টিভিকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে এসব বিষয় নিয়ে বলেছেন জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ডা. লেলিন চৌধুরী। সাক্ষাৎকারটি নিয়েছেন ডক্টর টিভির রিপোর্টার দেলাওয়ার হোসাইন দোলন…
প্রশ্ন: কোরবানির বর্জ্য অপসারণে সরকারের করণীয় কী?
পশু কোরবানি দেওয়া হয় ব্যক্তিগতভাবে। কিন্তু পশুর বর্জ্য ব্যক্তি থেকে ক্রমশ জমা হয়ে রাষ্ট্রীয় বিষয় হয়ে দাঁড়ায়। এজন্য বর্জ্য পরিষ্কারে দুটি বিষয় রয়েছে। একটি হচ্ছে কর্তৃপক্ষের অংশ আরেকটি হচ্ছে ব্যক্তির অংশ। ব্যক্তিগত অংশটা হচ্ছে- একজন মানুষ যে জায়গায় বসবাস করে এবং তার চারপাশ পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন রাখার দায়িত্ব তার। এটাকে আমরা বলি প্রাইভেট স্পেস। আরেকটা হচ্ছে পাবলিক স্পেস বা সাধারণ জায়গা। সে জায়গায় যদি কোনো বর্জ্য, ময়লা বা কোনো পরিত্যক্ত জিনিস ফেলা হয়, সেটির দায়িত্ব স্থানীয় সরকারের। সিটি করপোরেশন বা পৌরসভার। কোরবানির বর্জ্য একটি পর্যায়ে বেক্তিগত আঙিনায় হয়। পরে সেটি ফেলে দেওয়া হয় পাবলিক স্পেসে। ফলে দুই অংশকেই সমান দায়িত্ব পালন করতে হবে।
প্রশ্ন: নাগরিকদের করণীয় কী?
কোনো মানুষ যখন কোরবানি করবে, কোরবানি হয়ে যাওয়ার পরে সেখানকার বর্জ্য সঠিকভাবে ফেলবে। সিটি করপোরেশন অথবা পৌরসভা কর্তৃক নির্ধারিত স্থানে ফেলবে। সেখান থেকে পৌরসভা, সিটি করপোরেশন নিয়ে বর্জ্য ব্যবস্থাপনার যে প্রক্রিয়া, সেখানে যুক্ত করবে। অনেক ব্যক্তিকে আমরা দেখতে পাই- নিজের আঙিনায় কোরবানি দিয়ে মাংস নিয়ে যাওয়ার পরে বর্জ্যগুলো রাস্তার পাশে ফেলে দেয়। এটি করা যাবে না। এক্ষেত্রে তাকে দায়িত্বশীল হতে হবে। বর্জ্য ফেলার যে নির্দিষ্ট জায়গাটি রয়েছে, সেখানে তা ফেলতে হবে।
অনেক সময় দেখা যায় সিটি করপোরেশনের পক্ষ থেকে বর্জ্য যখন নিয়ে যাওয়ার কথা, তখন নিচ্ছে না। এটিও হওয়া উচিত নয়। না নেওয়ার কারণে গন্ধ ছড়াবে, যেখানে নানা ধরনের জীবাণু জন্ম নিবে। কোরবানির মতো পবিত্র বিষয়ে বর্জ্য ব্যবস্থাপনায় দায়িত্ব ব্যক্তির এবং কর্তৃপক্ষের। সমানভাবে পালন করতে হবে।
প্রশ্ন: কর্তৃপক্ষের আর কী কী করণীয় আছে?
কর্তৃপক্ষের দিক থেকে তিন ধরনের কাজ করতে হবে। প্রথম কাজ হচ্ছে সচেতন করুন। আগে থেকেই মানুষকে জানাতে হবে- কোরবানির বর্জ্য কীভাবে পরিষ্কার করতে হয়, নিজ আঙিনা পরিষ্কারের পর কোথায় নিয়ে রাখতে হবে। রাস্তায় ছড়িয়ে ফেলা যাবে না। এই বিষয়গুলো সচেতন করার জন্য প্রচার চালাতে হবে। স্থানীয় সরকার প্রত্যেকটি জায়গায় তাদের জনপ্রতিনিধিদের মাধ্যমে কাজ করবে। প্রতিটি পাড়া-মহল্লায় একজন ব্যক্তিকে কেন্দ্র করে কয়েকজনের একটা স্বেচ্ছাসেবক টিম করে দেবেন। সেই টিম প্রত্যেকটি বাড়ি গিয়ে বলবে, এটা আপনারই দায়িত্ব। এটা যদি আপনি না মানেন, তাহলে আপনার চারপাশের মানুষ ভোগান্তিতে পড়বেন। ময়লা আবর্জনা থেকে দূষণ ছড়াবে, রোগ-জীবাণু ছড়াবে। এতে আপনি এবং আপনার পরিবারের লোকজন অসুস্থ হবেন। একই সঙ্গে চারপাশে লোক অসুস্থ হবে। পরিবেশ দূষিত হবে। এলাকার মানুষকে সংযুক্ত করার কাজটিকে আমরা বলি সংযুক্তকরণ।
পরের কাজটি হচ্ছে পরিষ্কারকরণ। পরিষ্কারকরণের জায়গায় থাকতে ব্যক্তিমানুষ, সে তার দায়িত্ব পালন করবে। কর্তৃপক্ষ তার দায়িত্বটি পালন করবে। এ তিনটি ধাপ যদি সফলভাবে পালন করা যায়, তাহলে কোরবানির বর্জ্য ব্যবস্থাপনা সঠিকভাবে সম্পন্ন করা যাবে।
প্রশ্ন: সঠিকভাবে বর্জ্য অপসারণ করা না হলে পরিবেশে কীরূপ প্রভাব পড়তে পারে?
যত্রতত্র বর্জ্য ফেললে অনেকগুলো ঝুঁকি বাড়বে। তার মধ্যে একটি হচ্ছে- পরিবেশ দূষিত হবে। বর্জ্যগুলো সেখানে পচে গিয়ে দুর্গন্ধ সৃষ্টি হবে। নানা ধরনের রোগ-জীবাণু জন্ম নিবে। সেগুলো কোনো না কোনোভাবে আমাদের খাদ্যচক্রের ঢুকে গিয়ে মানুষকে অসুস্থ করবে। এখান থেকে মিথেনসহ নানা ধরনের গ্যাস হবে। সেগুলো বায়ুমণ্ডলের যে মান, তা নষ্ট করে দিবে।
এই বর্জ্য গ্রহণের ফলে চারপাশের প্রাণিজগত, পথে জীবনযাপন করা কুকুর-বিড়াল, ইঁদুর-ছুঁচো তারা খাওয়ার মাধ্যমে রোগে আক্রান্ত হবে। পশুরা আক্রান্ত হয়ে তা ক্রমাগত মানুষের মধ্যে ছড়াবে। একই সঙ্গে এ রোগ ড্রেনের পানির সঙ্গে মিশে আমাদে খাবারের যে পানি সরবরাহ ব্যবস্থা রয়েছে তা দূষিত করতে পারে। এ পানি নদীর পানিতে গিয়ে জলজপ্রাণীর ক্ষতি করবে। একদিকে যেমন পরিবেশকে দূষণ করছে। দূষণ করছে পানিকে। ক্ষতি করছে জলজ প্রাণীর। প্রকৃতির বা পরিবেশের যদি একটি উপাদানকে ক্ষতি বা দূষণ করা হয়, সেটি বৃক্ষ হোক কিংবা জড়পদার্থ হোক বা অন্য প্রাণী বা মানুষ; ক্রমাগতভাবে একের সঙ্গে অপরের যে পারস্পরিক নির্ভরশীলতা, সে চক্রের মাধ্যমে এটি সমস্ত জীবনচক্রের প্রবাহিত হয় এবং ক্ষতি হয়। এমনিতেই করোনার এক দুঃসহ মহামারী অতিক্রম করতে গিয়ে, বিশ্বসহ বাংলাদেশের মানুষের নাভিশ্বাস অবস্থা। একই সঙ্গে ডেঙ্গু শুরু হয়েছে।
কোরবানির পশুর বর্জ্যকে কেন্দ্র করে যদি আবার নানা ধরনের রোগ ছড়ায়, তাহলে মানুষের বেঁচে থাকা, জীবনযাত্রা অত্যন্ত কষ্টকর হয়ে পড়বে। প্রত্যেকটি মানুষ যার যার জায়গা থেকে নাগরিক দায়িত্ব পালন করতে হবে। নাগরিক কর্তব্য এবং ব্যক্তি কর্তব্য মাধ্যমে আমরা সমস্ত বিষয় থেকে মুক্তি পাবো।
প্রশ্ন: বর্জ্য অপসারণে অবহেলা হলে দেশে ডেঙ্গুর বিস্তার বাড়তে পারে?
কোরবানির পশুর বর্জ্য ঘিরে বাড়ির আঙ্গিনায় যদি তিন দিনের বেশি পানি জমে থাকে, তাহলে সেখান থেকে এডিস মশার লার্ভা উৎপাদন করে। সে লার্ভাগুলো মশা হয়ে আশেপাশের লোকজনসহ প্রতিবেশীর লোকজনকে কামড়াতে শুরু করল, ডেঙ্গুর বিস্তৃতি ঘটবে। যেহেতু কোরবানির বর্জ্যের সঙ্গে সম্পৃক্ত হচ্ছে পানি। এমনিতেই ঢাকায় ডেঙ্গু সংক্রমণ বেড়ে গেছে; মৃত্যু বেড়েছে। এর সঙ্গে যদি আবার যুক্ত হয় ডেঙ্গুর সংক্রমণ, তাতে আরও বেড়ে যাবে মৃত্যু। এমনিতেই আমাদের হাসপাতালগুলোতে জায়গা নাই করোনার চাপে। ডেঙ্গু রোগীদের চিকিৎসার অবহেলা হচ্ছে। সেখানে আমরা চাইবো না কোনোভাবেই যেন ডেঙ্গুর বিস্তার ঘটে। অতএব সাবধানতা সমস্ত অর্থে অবলম্বন করতে হবে।