অসহায় চিকিৎসকের জীবন রক্ষার যুদ্ধ
ডা. জেসি হক
রাত ৯টা বাজে। বসে আছি উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের ইমার্জেন্সি রুমে। ৩৫ বছরের এক নারী প্রচণ্ড শ্বাসকষ্ট ও বুকে ধড়ফড় নিয়ে হাসপাতালে আসেন। এমন রোগীদের মনে করা হয় মানসিক কোন কারনে এমন করছেন, যেটা হিস্টেরিয়া নামেই বেশি পরিচিত। ইমার্জেন্সি রুমের অন্যরা তাই বলছিলেন।
কিন্তু আমি রোগীর এক্সামিন করলাম ভাল ভাবে। ব্লাড প্রেসার মেশিন দিয়ে প্রেসার মাপতে গিয়ে দেখি রোগির carpopedal spasm হচ্ছে মানে হাতের আঙুলগুলো বাঁকা হয়ে আসছিল। রোগীর পালস অনেক বেশি ছিল। আমি বুঝতে পারলাম রোগীর শরীরে ক্যালসিয়াম কমে গেছে। যাকে চিকিৎসকরা বলে হাইপোক্যালসেমিয়া।
উপজেলায় ক্যালসিয়াম মাপার কোন সুযোগ নেই। রোগীর মারা যায় যায় অবস্থা। রোগীর ২টা বাচ্চা আছে। একজনের বয়স দশ, আরেকজনের ছয়। ওরা মায়ের জন্য কান্নাকাটি করছিল। এই ঘটনার কয়েকদিন আগে আমি নিজেও মাকে হারিয়েছি।
বাচ্চা দুটার চেহারা দেখে আমি নিজেই ইমোশনাল হয়ে গেলাম। বাচ্চার মায়ের অবস্থা খারাপ। অথচ এ খারাপ অবস্থায় মা তার বোনকে (বাচ্চা দুটোর খালাকে) বলছিলেন, আমার ছেলে দুটাকে দেখে রাখিস। ওদের দেখার কেউ নাই।
এই না হলে মা!
ওনার এই কথা শুনে আমি ইমোশনাল হয়ে পড়লাম। আমি দ্রুত উনাকে Calcium gluconate injection দেয়ার সিদ্ধান্ত নেই।
পিছন থেকে একজন বললেন, স্যার ইনজেকশন দেয়ার দরকার নাই। রোগী মারা গেলে আমাদের ধরবে। কিন্তু আমি সাহস করে আস্তে আস্তে ইনজেকশন দিলাম। কিন্তু calcium gluconate injection দেয়ার পরেও রোগির কোন উন্নতি নেই। এরপর পালস যেহেতু আগে থেকেই বেশি ছিল, আমি দ্রুত ইসিজি করালাম। ইসিজি তে আসলো narrow complex tachycardia মানে অস্বাভাবিক হৃদস্পন্দন। আমার মনে হল এটা SVT বা এসভিটি।
কিন্তু রোগির আঙুল বাঁকা হয়ে আসা মানে carpopedal spasm হবে কেন? হঠাৎ আমার মাথায় আসলো রোগির রক্তে ম্যাগনেসিয়াম কমে গেছে। কারণ, ম্যাগনেসিয়াম কম হলেই আঙুল বাঁকা হওয়া ও অস্বাভাবিক হৃদস্পন্দন হতে পারে।
চিন্তা করছিলাম কী করব? ক্যলসিয়াম ইনজেকশন দিয়ে উপকার পাইনি। ম্যাগনেসিয়াম ইনজেকশন কি দিবো? এরকম নানা চিন্তা মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছিল আর বাচ্চা দুটোর চেহারা চোখে ভাসছিল। আমি রোগিকে ৫ মিলিগ্রাম Bisoprolol দিলাম এবং সাথে সাহস করে ইঞ্জেকশনে ম্যাগনেসিয়াম যা Nalepsin নামে পাওয়া যায় সেটা দেয়া শুরু করলাম।
৩০ মিনিটের মধ্যে রোগীর ড্রামাটিক উন্নতি হল। ৩০ মিনিট পর বুঝাই যাচ্ছিল না, এ রোগী একটু আগে মারা যাচ্ছিল।
উপজেলা স্তরে যেখানে ক্যলসিয়াম, ম্যাগনেসিয়ামের ব্যবস্থা নাই। আবার রাতে অন্য কোনো হাসপাতালে রেফার করলে রোগী পথেই মারা যেতে পারতো, নষ্ট হতে পারতো একটা পুরো ফ্যামিলি, দুটো বাচ্চা হতে পারতো এতিম।
রোগী মারা গেলে ইঞ্জেকশন দেয়ার কারনে মারধর কি খেতে হতো না? পত্রিকায় কি আসত না ভুল চিকিৎসায় দুটো শিশু এতিম?
আপনারাই বলেন, একজন ক্রিকেটারের চেয়ে কোন অংশে এ কাজটা ছোট? বিনিময়ে আমরা কি সে লেভেলে প্রতিদান কিংবা সম্মান পেয়েছি?
এ রকম শত শত জীবন রক্ষার গল্প নীরবেই রয়ে যাবে।
(ডা. জেসি হকের ফেসবুক থেকে ঈষৎ পরিমার্জিত করে ডক্টর টিভির পাঠকের জন্য প্রকাশিত হলো।)