চোখের চিকিৎসায় ডায়াবেটিস ও হাইপার টেনশন নিয়ন্ত্রণ জরুরি
গ্লকোমা চোখের মারাত্মক একটি রোগ।
চোখ মানব শরীরের মহামূলবান সম্পদ। এর পরিচর্যা না করলে মারাত্মক রোগে আক্রান্ত হতে পারে। নিয়মিত পরীক্ষা করে সঠিক চিকিৎসা নিলে চোখের রোগবালাই থেকে রক্ষা পাওয়া সম্ভব।
চোখের গ্লকোমা রোগ:
গ্লকোমা চোখের মারাত্মক একটি রোগ। বড়দের পাশাপাশি বাচ্চাদেরও গ্লকোমা হয়ে থাকে। এই রোগটি বিভিন্ন ধরণের হয়ে থাকে। মায়ের গর্ভ থেকেও গ্লকোমা হতে পারে। সেটাকে আমরা কনজেনিটাল গ্লকোমা বলে থাকি। আরেকটা হল জন্মের পর তিন বছরের পর থেকে গ্লকোমা হতে পারে। আর সেটাকে আমরা ডেভেলপমেন্ট গ্লকোমা বলি। আরেকটা হচ্ছে আঘাতজনিত গ্লকোমা। যেমন শিশুরা খেলতে গিয়ে চোখে আঘাত লাগা, যেকোনো দুর্ঘটনায় চোখে আঘাত লাগা, আর এসব আঘাতের ফলে গ্লকোমা রোগ হতে পারে, এটাকে সেকেন্ডারি গ্লকোমা বলা হয়।
গ্লকোমা রোগীদের ফলোআপে রেখে তাদের চোখের প্রেসার, চোখের নার্ভের অবস্থাটা দেখে তাদের চিকিৎসা দেয়া হয়। তার চোখে ছানি পড়ে যাচ্ছে কিনা, সেটা দেখে সবকিছু পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে তাদের ওষুধ দিয়ে থাকি। তাদেরকে নিয়ম অনুযায়ী ওষুধ সেবনের নির্দেশনা দেয়া হয়। তাদেরকে ফলোআপে থাকার নির্দেশনা দিয়ে থাকি।
গ্লকোমা চিকিৎসা সাধারণত নিয়মিত প্রক্রিয়া। এটাকে সময়মতো চিকিৎসা করাতে হবে। গ্লকোমায় নার্ভ নষ্ট হয়ে যায়। এক্ষেত্রে ওষুধ অথবা অপারেশনের মাধ্যমে নষ্টের পরিমাণ কমিয়ে রাখার চেষ্টা করা হয়। এক্ষেত্রে রোগীর নিজেরও এ ব্যাপারে সচেতন হওয়া খুবই প্রয়োজন। রোগীকে নিয়মিত ওষুধ সেবন করতে হবে। নিয়মিত চিকিৎসকের কাছে চেকআপের জন্য আসতে হবে। ডাক্তারের পরামর্শ অনুযায়ী যখন ওনাকে অপারেশনের জন্য বলা হবে, তখন সময়মতো অপারেশনের জন্য প্রস্তুতি নিবেন।
আরেকটি বিষয় বলবো, যাদের ডায়াবেটিস এবং হাইপার টেনশন আছে তারা অবশ্যই এই দু’টি নিয়ন্ত্রণে রাখবেন। মেডিসিন ডাক্তারের পরামর্শ অনুযায়ী তারা ডায়াবেটিস এবং হাইপারটেনশনের চিকিৎসা করাবেন। এই দু’টো জিনিস আপনারা নিয়ন্ত্রণে রাখবেন। কারণ, এই দু’টি নিয়ন্ত্রণে না থাকলে চোখের সমস্যাও বেড়ে যাবে। আর চোখের সমস্যা বেড়ে যাওয়ার ফলে গ্লকোমা সমস্যাও বেড়ে যাবে।
আমরা বলব অন্ধত্বের দ্বিতীয় প্রধান কারণ হচ্ছে গ্লকোমা। গ্লকোমার ব্যাপারে সচেতন হওয়া প্রয়োজন এজন্য যে, গ্লকোমার কারণে দৃষ্টিশক্তির স্থায়ী পরিবর্তন হয়ে যাবে। গ্লকোমা রোগে চোখের প্রেসারের ফলে অপটিক্যাল নার্ভ নষ্ট হয়ে যায়। আর অপটিক নার্ভ নষ্ট হল স্থায়ী । এই নষ্ট হল ইরিভার্সিবল ড্যামেজ। যেটা চিকিৎসার পরও আর ক্ষতিপূরণ করা যায় না। গ্লকোমা রোগের ফলে চোখের দৃষ্টিশক্তি যেটা কমে যাবে সেটা আর ফেরত আনা যাবেনা। এটা হচ্ছে স্থায়ী ড্যামেজ। তাই গ্লকোমা রোগ সঠিক সময় নির্ণয় করে দ্রুত চিকিৎসা করা খুবই জরুরি।
চোখের অ্যালার্জি সমস্যা:
বিভিন্ন কারণে চোখে অ্যালার্জি সমস্যা হয়ে থাকে। এজন্য রোগীকে অবশ্যই তার এলার্জির কারণ নির্ণয় করতে হবে। যেমন অনেকের খাবার-দাবার থেকে এলার্জি সমস্যা হয়,আবার কারো ধুলাবালি থেকেও অ্যালার্জি হতে পারে। যে কারণেই হোক না কেন আপনাকে সেই পরিস্থিতি এড়িয়ে চলতে হবে। তারপরও অ্যালার্জির সমস্যা বেশি হলে আপনাকে চিকিৎসকের শরণাপন্ন হতে হবে। ড্রপ ও যাবতীয় ওষুধ ব্যবহার করতে হবে। মনে রাখতে হবে, এমন কিছু ওষুধ আছে যা চিকিৎসকের পরামর্শ ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না। কিছু অ্যালার্জিক ওষুধ আছে যেগুলো স্টেরয়েড জাতীয়। আমরা বলি, যেটা দিলে আপনার রোগটা ভালো হবে খুব তাড়াতাড়ি, কিন্তু এতে পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া আছে। যেমন এতে চোখে গ্লকোমা রোগ হবে। এটাকে স্টেরয়েড ইঞ্জুর গ্লকোমা বলে থাকি আমরা। সেজন্য এ অ্যালার্জিক রোগীদের আমরা ডাক্তারের পরামর্শ ছাড়া ওষুধ গ্রহণ করতে নিষেধ করি।
চোখ দিয়ে পানি পড়া:
চোখ দিয়ে পানি পড়া এটা আমাদের দেশে একটি সাধারণ সমস্যা। এটা আসলে বিভিন্ন কারণে হতে পারে। একটি হলো, আমাদের চোখে স্বাভাবিকভাবেই ন্যাচারাল পানি আসে। কিন্তু কোনো কারণে যদি চোখ শুকনো হয়ে যায়, তখন চোখে পানি বেশি আসে। আরেকটি কারণ হলো, অ্যালার্জি সমস্যার কারণে তাদের চোখে পানি চলে আসে।
আলোর দিকে তাকাতে পারে না। এছাড়া আমাদের চোখ থেকে নাকের ভিতরের দিকে একটা পাইপ থাকে, এটাকে আমরা নেত্রনালী বলি। অনেক সময় যদি এটি ব্লক হয়ে যায়, এখানে চোখ সেটা ধারণ করতে পারে না। আর তখন চোখ দিয়ে পানি বের হয়ে আসে। অনেক সময় চোখের পাতার নিচে ময়লা আটকে থাকে, সেটা স্বাভাবিক ভাবে দেখা যায় না। তখন সেটা আমরা চোখের পাতা উল্টিয়ে মেশিন বসিয়ে দেখি একটা ছোট ময়লা আটকে আছে। এতে ইরিটেশনের ফলে চোখ দিয়ে পানি বের হয়ে আসে। এজন্য চোখ দিয়ে পানি পড়লে ডাক্তারের কাছে গিয়ে কারণ নির্ণয় করতে হবে এবং সে অনুযায়ী চিকিৎসা নিতে হবে।
চোখ দিয়ে পানি পড়া রোগী আসলে আমাদের বহির্বিভাগ সেবা চালু আছে। তারা পরীক্ষা-নিরীক্ষার পর বিভিন্ন বিশেষজ্ঞের কাছে পাঠিয়ে থাকেন। যেমন, কারো যদি চোখ শুকিয়ে যায়, তাদেরকে কর্নিয়া বিভাগে পাঠানো হয়। কারো চোখের নেত্রনালী সমস্যার কারণে চোখে পানি আসে, তখন তাদেরকে অকমা প্লাস্টি বা ডিসিআর বিভাগে পাঠানো হয়। সর্বোপরি রোগীর সমস্যা অনুযায়ী বিভিন্ন বিভাগের বিশেষজ্ঞরা চিকিৎসা দিয়ে থাকেন।
চোখের পাপড়ি ওঠানামা:
যখন মাথাব্যথা করে তখন চোখের পাপড়ি উঠানামা বা কাপাকাপি করে। এটা একটি স্বাভাবিক সমস্যা। এক্ষেত্রে ঘুমটা নিয়মিত হতে হবে, ডায়েট মেন্টেন করতে হবে। চা-কফি খাওয়ার অভ্যাস যাদের খুব বেশি সেটা কিছুটা কমাতে হবে। কারণ চা-কফি খাওয়ার পরিমাণ বেশি হলে এই সমস্যাটা বেশি হয়। পানি বেশি পরিমাণে পান করতে হবে।
এরপরেও যদি সমস্যা থাকে, তখন রোগীকে এনজিওলাইটিক কিছু ওষুধ দিয়ে থাকি। কিছু চোখের ড্রপ দিয়ে থাকি। স্বাভাবিক ভাবেই আমরা রোগীদের বলে থাকি, আপনি নিয়মমাফিক নির্দিষ্ট সময় মতো ঘুমাবেন, ছয় থেকে আট ঘণ্টা ঘুমাবেন। নিয়মিত খাবার খাবেন, দু:শ্চিন্তা কম করবেন, চা-কফি কম পান করবেন, প্রচুর পানি পান করবেন। এছাড়াও কিছু দিনের জন্য আমরা চোখের জন্য আর্টিফিশিয়াল কেয়ার দিয়ে থাকি। এগুলো নিয়মমাফিক মেনে চললে সমস্যাটা কমে যাবে।
চোখের অপারেশন:
তবে চোখের এমন কিছু রোগ আছে যেগুলোর জন্য ইনজেকশন নিতে হয়। যেমন ডায়াবেটিস রোগীদের ক্ষেত্রে অনেক সময় চোখে রক্তক্ষরণ হয়। এর প্রতিকারের জন্য চোখে ইনজেকশন নেয়ার প্রয়োজন হয়। আর কিছু কিছু রোগ আছে যেগুলোতে হয়তো আমরা চোখে ইনজেকশন দিচ্ছি না। কিন্তু সেগুলোতে হাতের শিরায় ইনজেকশন দেয়া হয়। যেমন গ্লকোমা রোগের ক্ষেত্রে চোখের প্রেসার যদি নিয়ন্ত্রণে না থাকে, তখন আমরা ড্রপ বা ট্যাবলেট দিয়েও চোখের প্রেসার নিয়ন্ত্রণে করতে পারছিনা। সেক্ষেত্রে কিছু রোগীকে রক্তের শিরার মাধ্যমে ইনজেকশন দিয়ে চিকিৎসা করা লাগতে পারে।
চোখের অপারেশনেরর ক্ষেত্রে সাধারণ ছানি অপারেশনের সময় কোন ইনজেকশন দেয়া লাগে না। সেক্ষেত্রে ট্রপিক্যাল ড্রপ বা জেলের মাধ্যমে অপারেশন করা হয়। তবে অন্যান্য রোগের ক্ষেত্রে যেমন গ্লকোমা সার্জারির ক্ষেত্রে ইনজেকশন দিয়ে অপারেশন করতে হয়। তারপর রেটিনার অপারেশনগুলোও ইনজেকশন দিয়ে করতে হয়। রেটিনা, অকোমা প্লাস্টিক সার্জারির ক্ষেত্রেও অপারেশন করতে হয়।
লেখক: ডা. তানিয়া রাহমান ছড়া
সহকারী অধ্যাপক ও জুনিয়র কনসালট্যান্ট, গ্লকোমা বিভাগ
ইস্পাহানী ইসলামিয়া আই ইনস্টিটিউট অ্যান্ড হসপিটাল