মৃত্যুর পদধ্বনি!

ডা. মো তরিকুল হাসান
2021-05-16 06:47:09
মৃত্যুর পদধ্বনি!

প্রতীকী ছবি

১.

আজ চেম্বারে ঢুকতেই সিস্টার বললো, 'স্যার গত সপ্তাহে আপনি যে রোগীটাকে খুব খারাপ বলেছিলেন সে মারা গেছে।'

মনে পড়লো…

গত সপ্তাহে রোগী দেখা শেষ, এখনই বের হবো। ম্যানেজার বললো, 'স্যার একটা রোগী পথে আছে। একটু দেখে গেলে ভাল হয়।'

রোগী চেম্বারে ঢুকতেই থমকে গেলাম। নিঃশ্বাসটা খুব অস্বাভাবিক। মনে কূ-ডাক ডাকলো।

রোগী দেখা শেষে আমি রোগীর ছেলেকে বললাম, 'আপনার মা জীবন-মৃত্যুর সন্ধিক্ষণে। এখনি তাকে ফরিদপুর নিয়ে যান।' রোগীর লোকজন বিভিন্ন অজুহাত দেখাতে চাইলো। আমি পাত্তা দিলাম না। তারা বললো, আপাতত উপজেলা হাসপাতালে ভর্তি করি। আমি বললাম, 'জেলা পর্যায়েও তাকে ম্যানেজ করা কঠিন। তাকে বাঁচাতে চাইলে সময় নষ্ট করা যাবেনা।'

২.

ঢাকায় এক ডায়ালাইসিস সেন্টারে ডিউটি করছিলাম। একটা রোগীকে ফলোআপ দিতে গিয়ে কেমন যেন লাগলো। আমি কনসাল্টেন্ট স্যারকে ফোন দিলাম। স্যার তার ব্যস্ততা ম্যানেজ করে দ্রুত এলেন। আমি বললাম, "স্যার আমি ঠিক বুঝতে পারছিনা, তবে আমার মনে হচ্ছে উনি খুব অস্বাভাবিক।'

স্যার আমাকে বেশ স্নেহ করতেন। অনেকক্ষণ রোগীটাকে দেখলেন। তারপর হাল ছেড়ে দেয়ার ভঙ্গীতে বললেন, 'কই কোন অস্বাভাবিক কিছুতো পাচ্ছিনা।'

দুই দিন পর ডিউটিতে গিয়ে শুনলাম, মৃত্যু তাকে টেনে নিয়ে গেছে!

৩.

ঈদের দুই-এক দিন আগের কথা। বাসায় গিয়ে শুনি এক রিলেটিভ হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পড়েছে। গিয়ে দেখি, ক্লিনকাট স্ট্রোক। হেমোরেজিক হতে পারে বলে মনে হল। এ ধরনের স্ট্রোকের প্রগনোসিস বেশ খারাপ। আমি ঢাকায় নিতে বললাম।

লোকজন বললো, ঈদটা পার হোক। আমি যেন কোনভাবে ম্যানেজ করি।

আমি বললাম, 'রোগ-ব্যধি, মৃত্যু এগুলো ঈদ দেখে আসে না। কোন উপায় নেই।'

আমার নাছোড়বান্দা মনোভাব দেখে তারা দ্রুতই ঢাকা নিয়ে গেল।

ঈদের দিন সকালে মসজিদের মাইকে শুনতে পেলাম, 'একটি শোক সংবাদ ...

৪.

কয়েক বছর আগের কথা ...

আমি নাটোরের এক নিভৃত গ্রামে কুলখানীতে উপস্থিত হয়েছি। মৃতার এক ছেলে মজলিসে উঠে দাড়ালেন। গ্রামে মোটা ফ্রেমের চশমা পড়া বোকা বোকা চেহারার আমাকে দেখে অনেককেই কৌতুহলি দেখা গেল। আমার দিকে ইঙ্গিত করে তিনি বললেন, 'এই ডাক্তারের হাতেই আমার আম্মার মৃত্যু হয়েছে।'

আমি আৎকে উঠলাম। ভদ্রলোক একটু কেশে বললেন, 'মানে এই স্যার আম্মার মৃত্যুর সময় উপস্থিত ছিলেন।'

উনার মৃত্যু হয়েছে যে ক্লিনিকে আমি তার আবাসিক মেডিকেল অফিসার। সাধারণত মৃত্যুর পরপরই রোগীর লোকজন ডাক্তারদের উপর চড়াও হয়ে সব দোষ ডাক্তারের ঘাড়ে চাপিয়ে দেন। আমি তাদেরকে সেই সুযোগ দেইনি।

রোগী আসার পর দেখেই বুঝতে পারলাম, রোগী ভয়াবহ খারাপ। রাজশাহী মেডিকেলে নেয়ার মত সময় হাতে নেই। জরুরি ব্যবস্থা নেয়ার সঙ্গে সঙ্গে লোকজনকে কাউন্সেলিং করলাম, আমার মনে হয় রোগী মৃত্যুর দিকে ধেয়ে যাচ্ছেন।

ইমার্জেন্সি ম্যানেজম্যান্টের সাথে সাথে তাকে কালিমা পড়ানোর চেষ্টা করলাম। অল্পক্ষণ পর মৃত্যু এসে হানা দিল।

দিনদিন আমার ঝুলিতে এ ধরনের গল্প বাড়ছে। একদিন আমার মৃত্যুর পদধ্বনিও হয়তো কারো গল্পে ঠাঁই নেবে!


আরও দেখুন: