ডায়াবেটিস রোগীদের হৃদরোগের ঝুঁকি ও করণীয়

সাক্ষাৎকার গ্রহণ: ফখরুল ইসলাম
2021-05-04 10:35:50
ডায়াবেটিস রোগীদের হৃদরোগের ঝুঁকি ও করণীয়

অধ্যাপক ডা. এসএম মোস্তফা জামান

ডায়াবেটিস একটি মেটাপলিক রোগ। ইনসুলিনের পরিমাণ কমে গেলে রক্তে চিনির পরিমাণ বেড়ে যাবে। এজন্য পারিপার্শ্বিক ও বংশগত দুই কারণই থাকে। বর্তমানে বিশ্বে ৪০ কোটি মানুষ ডায়াবেটিসে আক্রান্ত। বাংলাদেশে এ সংখ্যা ৮০ লাখের মতো।

ডক্টর টিভিকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে ‘ডায়াবেটিস রোগীদের হৃদরোগের ঝুঁকি ও করণীয়’ নিয়ে আলোচনা করেছেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যায়ের কার্ডিওলজি বিভাগের অধ্যাপক ডা. এসএম মোস্তফা জামান। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন ফখরুল ইসলাম

ডক্টর টিভি: স্যার, আপনার কাছে প্রথমে জানতে চাইবো- কী কী বিষয় ডায়াবেটিসের ঝুঁকি বাড়িয়ে দেয়?

অধ্যাপক জামান: ডায়াবেটিস আর হৃদরোগ এতটাই পারস্পরিক সম্পর্কযুক্ত যে, আমরা যে সকল রোগীদের এনজিওগ্রাম করি, তাদের মধ্যে যাদের ব্লক পাওয়া যায় অথবা রিং পরানো লাগে তাদের বেশির ভাগই ডায়াবেটিসে ভুগতে থাকেন। ডায়াবেটিস রোগীদের করোনারি ধমনিতে ব্লক হওয়ার জন্য তাদের কারো কারো রিং লাগে আবার কারো কারো বাইপাস সার্জারি লাগে। সেজন্য যদি প্রথম চেকেই ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণ করতে পারা যায় তাহলে হৃদরোগ এড়ানো সহজ হয়। দেখা যাচ্ছে বিশ্বব্যাপী যাদের ডায়াবেটিস আছে, তাদের হৃদরোগ হওয়ার সম্ভাবনা থেকে যায়। বঙ্গবন্ধু মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ে আমরা ৩৫ বছরের নিচের যুবকদের নিয়ে একটি গবেষণা করেছি। সেখানে দেখা গেছে পৃথিবীর অন্যান্য দেশে যে বয়সে হৃদরোগ হয়, সে বয়সে বাংলাদেশে প্রায় ১৭-২৫ গুণ বেশি হৃদরোগ হওয়ার সম্ভাবনা আছে। তাই আমরা বলছি, যাদের পরিবারে ডায়াবেটিস আছে, তাদের হৃদরোগও বেশি দেখা যায়। আর যাদের তামাক জাতীয় দ্রব্য নেওয়ার অভ্যাস আছে আর যারা শারীরিক পরিশ্রম কম করে বা হাঁটাহাটি কম করে, চর্বি জাতীয় খাদ্য বেশি খায় এবং কাঁচা শাক-সবজি ও ফলমূল কম গ্রহণ করে তাদের ডায়াবেটিস ও হৃদরোগ বেশি হয়ে থাকে।

ডক্টর টিভি: সাধারণ হৃদরোগী আর ডায়াবেটিসে আক্রান্ত রোগীদের মধ্যে উপসর্গের কোনো পার্থক্য আছে কিনা?

অধ্যাপক জামান: অবশ্যই পার্থক্য আছে। প্রথমত হৃদরোগ যাদের করোনারি ধমনিতে সমস্যা আছে, তাদের হয়ে থাকে। যদি এটি ১০০% ব্লক হয়, তাহলে হার্ট অ্যাটাক হতে পারে। আর যদি ৭০-৯৫% ব্লক হয় তাহলে হাঁটলে বুকে ভার অনুভূত হবে। আর যাদের মধ্যে নিয়ন্ত্রণহীন ডায়াবেটিস থাকে তাদের হার্ট অ্যাটাক হলেও বুকে ব্যথা নাও হতে পারে। যাদের ডায়াবেটিস নরমাল তাদের বুকে ব্যথা, প্রচুর ঘাম যাওয়া আর বমি হলেও যাদের অনিয়ন্ত্রিত তাদের এগুলো নাও হতে পারে। তার মানে যাদের ডায়াবেটিস আছে তারাই বেশি হৃদরোগ ঝুঁকিতে আছেন। অন্যরা যেখানে রোগের পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে বুকের ব্যথা বুঝতে পারছেন, সেখানে ডায়াবেটিস রোগীরা কিছুই বুঝতে পারছেন না। এটি তাদের জন্য বড় একটি অশনিসংকেত। এই একটি পার্থক্য আমরা বিশেষভাবে জোর দিচ্ছি। তাছাড়া যাদের ডায়াবেটিস আছে, তাদের রক্তনালীতে এমন এমন কিছু ব্লক হয়ে যায় যা একেবারে ডিফিউজ বা খুব খারাপ ধরনের। আর যাদের ডায়াবেটিস নেই তাদের রক্তনালীতে পাওয়া যায় ছোট ছোট ব্লক। তাই তাদের রক্তের শর্করা সুনিয়ন্ত্রণ রাখতে হবে। এতে কোনো কার্পণ্য করা যাবে না। আমরা সবসময় চারটি ’ডি’ এর কথা বলে থাকি। এক. ডায়েট। দুই. ডিসিপ্লিন। তিন. ড্রাগ। চার. ড্রিম বা ঘুম। এই চারটি ‘ডি’ কে নিয়ন্ত্রণ করতে পারলে আমরা হৃদরোগের ঝুঁকি কমাতে পারবো।

ডক্টর টিভি: ডায়াবেটিস রোগীদের কোন কোন বিষয়গুলো হৃদরোগের ঝুঁকি বাড়াচ্ছে?

অধ্যাপক জামান: ডায়াবেটিস বিভিন্ন ধরনের হয়ে থাকে। আমরা টাইপ-২ ডায়াবেটিস নিয়েই বেশি আলোচনা করেছি। কারণ এই ডায়াবেটিসটাই বেশি হয়ে থাকে এবং যার সঙ্গে হৃদরোগের ঝুঁকিটাও একটু বেশি থাকে। যদি আমরা ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণ করতে না পারি, তাহলে ব্রেইন স্ট্রোক হতে পারে, ঘাড়ের রক্তনালীতে ব্লক হতে পারে, হার্টের রক্তনালীতে ব্লক হতে পারে, হাতের রক্তনালীতে ব্লক হতে পারে, কিডনির রক্তনালীতে ব্লক হতে পারে, পায়ের রক্তনালীতে ব্লক হয়ে লেগ অ্যাটক হতে পারে। এর ফলে দেখা গেল রোগীর আঙুল কেটে ফেলতে হয় এবং পা কেটে ফেলতে হয়। তাই আমরা বলি ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণ করতে পারলে হার্ট অ্যাটক হবে না আর মস্তিস্কের রক্তনালীতেও কোনো ব্লক হবে না এবং পায়ের রক্তনালীতেও ব্লক  হবে না। অর্থাৎ ডায়াবেটিস শরীরের প্রত্যেকটি অঙ্গে আঘাত হানতে পারে যা হার্ট অ্যাটাকের দিকে নিয়ে যায়।

ডক্টর টিভি: স্কেমিয়া হার্ট ডিজিজ কী আর এতে আক্রান্ত হলে কীভাবে বুঝতে পারবো?

অধ্যাপক জামান: প্রত্যেকটি মানুষের শরীরে ইনসুলিন বা এরকম কিছু হরমোন থাকে যা দিয়ে আমরা রক্তের শর্করাকে নিউট্রালাইজ করি। কার্বোহাইড্রেট জাতীয় যে খাবারগুলো আছে তা জারণ-বিজারণে সহযোগিতা করে। আর কোনো কারণে যদি এই হরমোনের সমস্যা হয়ে থাকে, তখন আমরা বাইরে থেকে হয় ইনসুলিন দিয়ে থাকি না হয় ওষুধের মাধ্যমে ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণ করে থাকি। যদি এ জারণ-বিজারণ আর রক্তে চর্বির আধিক্য হয়ে থাকে, হাঁটা-চলা, বুকে ব্যথা হলে সেটাকে আমরা বলে থাকি আন্সটেবল এনজেনা। আর ১০০% ব্লক হলে তখন হার্ট অ্যাটক হয়। আর আমরা ইসিজি পরিক্ষার মাধ্যমে জানতে পারি তার হার্ট অ্যাটক হয়েছে। তখন আমরা তাৎক্ষণিকভাবে বাড়িতে যদি এসপিরিন জাতীয় ওষুধ থাকে তখন আমরা সেটি চিবিয়ে খেয়ে ফেলতে বলি আর হাসপাতালে নিয়ে যেতে বলি। আর যাদের নিয়মিত অস্বস্থি লাগে বা খারাপ লাগে, তাহলে তাকে নিয়মিত চেকআপে থাকতে হবে। যদি তার ইটিটি পজেটিভ থাকে তাহলে তাকে এই বিষয়ে সতর্ক হওয়া উচিত। আর কারো কারো ক্ষেত্রে করোনারি এনজিওগ্রামের মাধ্যমে আমরা ব্লকে রিং পরিয়ে দিই অথবা কারো কারো ক্ষেত্রে বাইপাস সার্জারি করতে হয়। তবে আমরা সবাইকে রিং পরাই না। বরং চেষ্ট করি ওষুধের মাধ্যমে বা সুশৃঙ্খল জীবন-যাপনের মাধ্যমে তাকে সুস্থ রাখতে। আবার অনেকের ক্ষেত্রে ডায়েট, ইনসুলিন ও ওষুধ সবই প্রয়োজন হয়। প্রথম থেকে যদি কেউ সুশৃঙ্খল জীবন-যাপন না করে, তাহলে তার জন্য সব রকম চিকিৎসা প্রয়োজন হয়।

ডক্টর টিভি: যাদের হৃদরোগের ঝুঁকি বেশি তাদের জীবন পদ্ধতি কেমন হতে পারে?

অধ্যাপক জামান: ডায়েট। এ ক্ষেত্রে একটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। আমরা অনেকে মনে করি ডায়াবেটিস হলে আমরা অনেক কিছুই খেতে পারবো না। কিন্তু এটি ভুল ধারণা। একসঙ্গে বেশি না খেয়ে আমাদের অল্প অল্প করে বেশি খাবার খেতে হবে। তবে মিষ্টি বা কোমল পানীয় খাওয়া থেকে বিরত থাকতে হবে। কারণ কোমল পানীয় রক্তের শর্করার পরিমাণ বাড়িয়ে দেয়। তাই আমরা বলি এমন খাবার খেতে হবে যেখানে কার্বোহাইড্রেট কম থাকে। শাক-সবজি ও কাঁচা ফলমূল খেতে হবে আর সাথে প্রোটিন যুক্ত খাবার খেতে হবে। আবার অনেকে মনে করে ভাত খাওয়া যাবে না। শুধু রুটি খেতে হবে। এটিও ভুল ধারণা। ভাত বা রুটি দুটিই খেতে পারবে। কারণ দুটিই শর্করা জাতীয় খাদ্য। তবে তা পরিমাণমতো খেতে হবে। বর্তমানে অনেক ডায়েট প্রচলিত আছে। গবেষণায় বলা হচ্ছে সবচেয়ে উপকারী ডায়েট হলো ভেজিটেরিয়ান ডায়েট। এই ডায়েটে শাক-সবজির পরিমাণই বেশি। আবার অনেকে চর্বি জাতীয় ডায়েটের কথা বলছেন। কিন্তু এটি ঠিক নয়। আর খারাপ ডায়েট হলো কিটো ডায়েট। তবে যারা দু-এক মাসের মধ্যে ওজন কমাতে চায়, তাদের জন্য এটি ভালো। কিন্তু যারা ডায়েবেটিসের রোগী তাদের জন্য কিটো অত্যন্ত ভয়ঙ্কর। কারণ গবেষণায় এসেছে তাদের কিডনি নষ্ট হতে পারে ও আয়ু কমে যেতে পারে। তাই ডায়েবেটিস রোগীদের ডাক্তারের পরামর্শ ছাড়া কোনো ডায়েট প্ল্যান করা উচিত না।

ডক্টর টিভি: বর্তমান সময়ে স্যোশাল মিডিয়া মাধ্যমে অনেকে কিটো ডায়েট করতে বলছেন আবার অনেকে নিষেধ করছেন। এর সমাধান কী?

অধ্যাপক জামান: আমার প্রথম মেডিকেলের টেক্সট বুক অনুসরণ করবো। আমরা অবশ্যই স্যোশাল মিডিয়ার ওই সব ভিডিও অনুসরণ করব না। কারণ আমাদের মেডিকেলের কোনো বইতে বা কোনো জার্নালে বা রিসার্চে কোথাও ডায়াবেটিস বা হৃদরোগের জন্য কিটো ডায়েটের কথা উল্লেখ নেই। টাইমস অব ইন্ডিয়া এক গবেষণায় ডায়াবেটিসের জন্য কিটো ডায়েটকে সবচেয়ে নিকৃষ্ট আর ভেজিটেরিয়ান ডায়েটকে সর্বোৎকৃষ্ট ডায়েট বলা হয়েছে। তাই আপনারা স্যোশাল মিডিয়ার এসব ডায়েট প্ল্যানকে অনুসরণ করবেন না। ডায়েট প্ল্যান করার আগে অবশ্যই ডাক্তারের পরামর্শ নেবেন।

ডক্টর টিভি: ডায়াবেটিস রোগীদের হার্টফেল হলে কী করণীয়?

অধ্যাপক জামান: অনেকে মনে করে হার্টফেল মানে হার্ট একবারে অকার্যকর হয়ে যাওয়া। এটি একটি ভুল ধারণা। হার্টের সংকোচন-প্রসারণের যে কার্যক্ষমতা সেটা যদি দুর্বল হয়ে যায়, তখন তাকে আমরা হার্টফেল বলি। মাঝে মাঝে বুকে পানি আসলে হাসপাতালে ভর্তি হওয়া দরকার হতে পারে। রক্তনালীতে কোলেস্টরল জমে হার্ট অ্যাটক হতে পারে। অর্থাৎ যাদের ডায়াবেটিস আছে তাদের সরাসরি হার্টফেল হতে পারে। সেজন্য আমাদের সুশৃঙ্খল জীবন-যাপন করা আর নিয়মিত চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী চিকিৎসা সেবা চালিয়ে যাওয়া উচিত।

ডক্টর টিভি: ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে ওষুধ এবং ইনসুলিনের মধ্যে কোনটি নিরাপদ?

অধ্যাপক জামান: প্রথমে যারা আগে থেকে চিকিৎসা করে থাকেন, তাদের জন্য কোনো ওষুধ বা ইনসুলিনের প্রয়োজন নেই। শুধু ব্যায়াম আর ডায়েট প্ল্যানের মাধ্যমে ডায়েবেটিস নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব। আর কখন ওষুধ লাগবে আর কখন ইনসুলিন লাগবে তার একটি আন্তর্জাতিক মানদন্ড আছে। এই নিয়ম-নীতি অনুসরণ করে চিকিৎসাকরা কার জন্য ওষুধ দরকার আর কার জন্য ইনসুলিন দরকার তা নির্ধারণ করে দেবেন। এটি এমন নয় যে কাউকে ইচ্ছে করে ইনসুলিন দিলাম আর আবার কাউকে ট্যাবলেট দিলাম। তবে আমাদের অনেকেই শুধু সুঁই ফোটানোর ভয়ে ইনসুলিন নেন না। তাই আমরা চেষ্টা করি মুখে খাওয়ার ওষুধের মাধ্যমে কীভাবে ডায়াবেটিসকে নিয়ন্ত্রণ করা যায়। আর যদি জীবনের ছন্দ, খাদ্য তালিকা, হাঁটাহাঁটি করেন, তাহলে আমাদের ওষুধ দেওয়ার পরিমাণ কমে দিই। আর সঙ্গে সঙ্গে ইনসুলিন দেওয়ার পরিমাণও কমিয়ে দিই। তবে যদি তিন মাসের ডায়াবেটিসের গড় ৯.৫% এর উপরে চলে যায় তখন, তার হৃদরোগ, স্ট্রোক, পায়ের রক্তনালী ব্লক হওয়ার ঝুঁকি থাকবে; তাদের জন্য অবশ্যই ইনসুলিন প্রয়োজন। আমরা অনেক সময় একটি ট্যাবলেটের চার ভাগের এক ভাগ দিয়েও ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণ করতে পারি। আবার কখনো দেখা যায় সকাল ও রাতে ৫০ করে ইনসুলিন দিয়েও তা নিয়ন্ত্রণ করা যায় না। সুতরাং মনে রাখতে হবে আমরা যত দ্রুত চিকিৎসা করাতে পারবো, ততই আমাদের জন্য ভালো। আমরা রোগ নিয়ন্ত্রণ করতে পারবো। ডাক্তার যে ডোজ দেয় সেটা নেওয়ার পর বাড়িতে যদি আমরা কোনো পরীক্ষা না করি, তাহলে সে ডোজ নেওয়ার পরও হার্ট অ্যাটাকের ঝুঁকি থেকে যায়।

ডক্টর টিভি: কার্ডিওমায়ুপেথির গুরুত্ব কী এবং ডায়াবেটিস রোগীর ক্ষেত্রে এর উপসর্গ ভিন্ন কিনা?

অধ্যাপক জামান: আমরা ইতিমধ্যে জেনেছি হার্টের সংকোচন-প্রসারণের মাধ্যমেই হার্টফেল হয়। সাধারণভাবে আমরা অনেককে বলে থাকি অনেক বড় হৃদয়ের মানুষ। কিন্তু মেডিকেলের ভাষায় এই হার্ট বড় হয়ে যাওয়াকেই বলা হয় কার্ডিওমায়ুপেথি। অর্থাৎ এই বুকের হার্টটা যদি পেটে চলে আসে, হার্ট বড় হয়ে যায়, হার্টের মাংসপেশি বড় হয়ে যায়, তখন তাকে বলা হয়ে থাকে কার্ডিওমায়ুপেথি। আর এর সঙ্গে ডায়াবেটিস ওতপ্রোতভাবে জড়িত। কারণ হার্টের সকল রোগের সাথে ডায়াবেটিসের একটা সম্পর্ক আছে।

ডক্টর টিভি: পেস্টিং ব্লাড সুগার নরমাল কত আর এইচবিএ১সি কত?

অধ্যাপক জামান: আমরা বলে থাকি যে, খালি পেটে ৭.১ মিলিমল যদি খাওয়ার দু’ঘন্টা পরে লেভেল ০.১ এর উপরে বা এইচবিঅনসি ৬.৫% এর উপরে থাকে তখন তাকে বলব ডায়াবেটিস। 

ডক্টর টিভি: কম বয়সীদের কীভাবে ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণ করা যেতে পারে?

অধ্যাপক জামান: ডায়াবেটিস কিন্তু খুব ছোট বয়সে এমনকি জন্মের পরপরও হতে পারে। আর সেটি হলো টাইপ-১ ডায়াবেটিস। যেহেতু তার বয়স কম, সেহেতু তার ডায়েবেটিস সেরকম কিনা যাচাই করতে হবে। আর টাইপ-১ হলো ইনসুলিন নির্ভর ডায়াবেটিস। তাই ট্যাবলেট খেয়ে এটি সমাধান করা যাবে না। ধরুন, ডোজের ক্ষেত্রে যদি সকাল বেলা ১০ ইউনিট আর রাতের বেলা ৮ ইউনিট ইনসুলিন দেওয়া হলো। তখন যদি সকাল বেলা খালি পেটে মাপার পর রক্তে শর্করার মাত্র বেশি থাকে, তাহলে রাতের ডোজটি বাড়াতে হবে। আর খাওয়ার দুই ঘণ্টা পর যদি তার ডায়াবেটিসের মাত্রা বেশি থাকে তাহলে সকালের ইনসুলিনের ডোজ বাড়াতে হবে। এভাবে দুপুরে খাবার আগে আর দুপুরে খাবার পরে, রাতে খাবার আগে আর রাতে খাওয়া পরে এরকম প্রতিদিন অন্তত তিন দিন ছয় বেলা মাপতে পারলে তাহলে তার রোগের প্রোফাইলটি পাওয়া যাবে। তখন আমরা তার ইনসুলিনের পরিমাণ নির্দিষ্ট করে দিতে পারি। তাই মনে রাখতে হবে, চিকিৎসক যেভাবে লিখে দেবে, সেভাবে চলবে তা কিন্তু নয়। এখন যেহেতু অনেক আধুনিক যন্ত্রপাতি আছে। তাই সে সকল যন্ত্রের সাহায্যে আমরা ক্যালরি হিসেব করে পাম্পের মাধ্যমে ইনসুলিনের ডোজটি দিয়ে থাকি। তবে রোগীর উচিত হবে কোন খাবারে কত ক্যালরি আছে তা জেনে নেওয়া। তখনই রোগী তার ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণ করতে সক্ষম হবে।

ডক্টর টিভি: নারী-পুরুষ ভেদে ডায়াবেটিসে আক্রান্তের মধ্যে কারা বেশি হৃদরোগে আক্রান্ত?

অধ্যাপক জামান: আগেই বলেছি ডায়াবেটিস যে কারো হতে পারে। তবে পরিবারের যদি বাবা-মায়ের যে কোনো একজনের ডায়াবেটিস থাকে, তাহলে সন্তানদের হওয়া সম্ভাবনা ৪০ শতাংশ আর যদি দু’জনেরই থাকে তাহলে ৮০ শতাংশ হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। তবে বাবা-মায়ের থাকলে যে সন্তানদের হবে তা কিন্তু ঠিক নয়। আবার কেউ যদি অল্পতেই মোটা হয়ে যান তাহলে, সেটা ডায়াবেটিসের কারণ হতে পারে। আবার অনেকে বলে থাকে মিষ্টি খেলে ডায়াবেটিস হয়। এটি ভুল ধারণা। তবে ডায়াবেটিস হলে সুগার খেতে বারণ করা হয় যাতে রক্তের শর্করা হঠাৎ করে বেড়ে না যায়। আরেকটি বিষয় হলো, কেউ যদি ছোটবেলা থেকেই খাদ্যাভাস মেনে চলেন, হাঁটাহাঁটি করেন বা কায়িকশ্রম করেন, তাদের পরিবারের ঝুকি থাকলেও তা প্রতিরোধ করতে পারবেন। বিশেষ করে জর্দা, তামাক, সাদাপাতা ইত্যাদি যদি ব্যবহার না করেন, তাহলে তার ডায়াবেটিস হওয়ার সম্ভাবনা কম। তবে মহিলাদের যখন মাসিক চলে, তখন হৃদরোগের আশংকা কম থাকে। কিন্তু পুরুষদের ঝুঁকি বেশি থাকে। আবার মাসিক বন্ধ হওয়ার পরে নারীদের হৃদরোগের ঝুঁকি বেড়ে যায়। তবে দেখা যাচ্ছে এখন সকল বয়সের নারী-পুরুষদের ডায়াবেটিস হচ্ছে।

ডক্টর টিভি: ডায়াবেটিস কি বংশগত রোগ?

অধ্যাপক জামান: ডায়াবেটিস বা অ্যাজমা বা রক্তচাপ যেটি বলুন না কেন এগুলো একবার হলে সারা জীবন থেকে যায়। ঠিক তেমনি হৃদরোগ একবার হলে, সারা জীবন থেকে যায়। কিন্তু তার মানে এই নয় যে, ডায়াবেটিস বা হৃদরোগ হয়েছে, তাই জীবন শেষ হয়ে গেল। আধুনিক চিকিৎসায় এগুলো প্রশমন করা সম্ভব হচ্ছে। আর অবশ্যই অনুমিত নিয়ম-কানুনগুলো ঠিকমত পালন করলে এগুলো থেকে মুক্ত হওয়া সম্ভব।

ডক্টর টিভি: ডায়াবেটিস রোগীরা হৃদরোগ এড়াতে কী কী বিষয় মেনে চলা অত্যন্ত জরুরি?

অধ্যাপক জামান: এই উত্তরের আগে আরেকটি কথা বলতে চাই। এই করোনায় অনিয়ন্ত্রিত ডায়াবেটিস রোগীরা ভ্যাকসিন নিতে পারবেন। অনেকে বলছে নিতে পারবেন না। তা কিন্তু ঠিক নয়। তবে বেশি মারাত্মক হলে সেটা ভিন্ন বিষয়। আর ডায়াবেটিস রোগীরা হৃদরোগ এড়াতে প্রথমে অবশ্যই খাদ্যাভ্যাস মেনে চলতে হবে। কাঁচা ফলমূল বেশি খেতে হবে। ভাত, চিনি, লবণ- এই তিন সাদা জিনিসকে পরিহার করতে হবে। আর অবশ্যই আঁশ জাতীয় খাবার বেশি খেতে হবে এবং সিম্পল কার্বোহাইড্রেট ও চর্বিযুক্ত খাদ্য পরিহার করতে হবে। হাঁটাহাঁটি, জগিং, সাইক্লিং, সাঁতারকাটা ইত্যাদি করা যেতে পারে। কারণ এগুলো খুব উপকারী অভ্যাস। বিশেষ করে হাঁটাহাঁটির অভ্যাস থাকলে যে কেউ একসঙ্গে ডায়াবেটিস আর হৃদরোগ নিয়ন্ত্রণ করতে পারবেন। সর্বেশষ বলবো, আপনি হাঁটুন, হাঁটুন এবং হাঁটুন।

ডক্টর টিভি: স্যার, এতক্ষণ ধরে আমাদেরকে আপনার গুরুত্বপূর্ণ সময় দেওয়ার জন্য আন্তরিক শুভেচ্ছা ও ধন্যবাদ জানাচ্ছি।

ডক্টর টিভি: ডক্টর টিভিকেও ধন্যবাদ জানাচ্ছি।


আরও দেখুন: