শরীরের ওজন কমাবেন কীভাবে

2021-03-04 06:18:42
শরীরের ওজন কমাবেন কীভাবে

ডা. শাহজাদা সেলিম

আজ ০৪ মার্চ, বিশ্ব অবেসিটি দিবস। ২০১৫ থেকে পৃথিবীব্যাপী দিবসটি উদযাপিত হচ্ছে। এবারের প্রতিপাদ্য বিষয় হলো: ‘প্রত্যেকে আমরা প্রতিজনের তরে’। উন্নত দেশগুলোয় স্বাস্থ্যব্যবস্থার প্রতি বিরাট চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিয়েছে জনগণের অতিরিক্ত দৈহিক ওজন।

যুক্তরাষ্ট্রের প্রাপ্তবয়স্ক মানুষের প্রতি ১০ জনে আটজন (৮০ শতাংশ) দৈহিক স্থূলতার ঝুঁকিতে আছেন। ইউরোপের দেশগুলোও পিছিয়ে নেই। জার্মানির মোট প্রাপ্তবয়স্ক জনসংখ্যার ৭০ শতাংশ এবং ইংল্যান্ডের ৬০ শতাংশ অতিরিক্ত দৈহিক ওজনের ঝুঁকিতে আছেন।

আমাদের মতো উন্নয়নশীল দেশগুলোয় আর্থিক অবস্থার উন্নতির সঙ্গে সঙ্গে জনগণের ওজন বৃদ্ধি পাচ্ছে লক্ষণীয় হারে। মনে রাখা দরকার, মানুষের সুস্বাস্থ্য নিশ্চিত করতে হলে প্রথমেই তাদের ওজন নিয়ন্ত্রণে রাখার চেষ্টা করতে হবে।

 

দেহের ওজন বাড়ে কেন

দৈহিক ওজন বৃদ্ধির মূল কারণ হলো শক্তি এবং তার ব্যবহারের মধ্যে অসংগতি। আমাদের গৃহীত প্রায় প্রতিটি খাবারেই শক্তি ক্যালরি হিসাবে থাকে। আমরা আমাদের পছন্দ, সামর্থ্য ও অভ্যাস অনুযায়ী খাদ্য গ্রহণ করে থাকি।

মানুষের বয়স, লিঙ্গ, ওজন আর দৈনন্দিন কাজের ওপর তার শরীরের ক্যালরির চাহিদা নির্ভর করে। প্রকৃতপক্ষে কেউ যদি তার প্রাত্যহিক চাহিদার চেয়ে বেশি ক্যালরি প্রতিদিন বা প্রায়ই খাবারের মাধ্যমে গ্রহণ করে, তবে তার বাড়তি অংশ শরীরে মেদ হিসাবে জমতে থাকবে।

 

ওজনাধিক্য নিরূপণের মাপকাঠি

দৈহিক স্থূলতা নিরূপণের জন্য বেশকিছু পদ্ধতি প্রচলিত আছে। এর মধ্যে বিএমআই পদ্ধতি সবচেয়ে বেশি ব্যবহৃত হয়। ইদানীং কোমর ও নিতম্বের ওজনের অনুপাতও ক্রমেই বিসদৃশ হয়ে উঠছে। মাত্র ৫ থেকে ১০ শতাংশ ওজন কমিয়ে অনেক স্বাস্থ্য সুবিধা পাওয়া যেতে পারে।

দৈহিক ওজন কমিয়ে আমরা অনেক রোগের ঝুঁকি বহুলাংশে কমাতে পারি:

  • এতে ডায়াবেটিসে আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কা কমে যাবে।
  • উচ্চরক্তচাপে ভোগার ঝুঁকি কমবে।
  • রক্তে ক্ষতিকর কোলেস্টেরল হ্রাস পাবে এবং উপকারী কোলেস্টেরল বাড়বে।
  • আর্থ্রাইটিসে পড়ার আশঙ্কা কমবে।
  • শ্বাসপ্রশ্বাসের উন্নত ঘটবে।
  • রাতে ভালো ঘুমের সম্ভাবনা বাড়বে।

 

ওজন কমাবেন কীভাবে

উপরের আলোচনা থেকে আপনি যদি এ সিদ্ধান্তে উপনীত হন যে, আপনার দৈহিক ওজন বেশি আছে এবং এর জন্য আপনাকে কোনো না কোনো সময় চরম মূল্য দিতে হতে পারে, তবে এ অবস্থা থেকে বেরিয়ে আসার জন্য আপনার দ্রুত কোনো চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়া উচিত।

তিনি আপাত ও স্থায়ী শারীরিক ঝুঁকি বিবেচনা করে আপনার জন্য করণীয় বলে দেবেন। আমি এখানে সংক্ষিপ্তভাবে ওজন কমানোর বা ওজন বৃদ্ধির হার হ্রাস করার পদ্ধতিগুলো নিয়ে আলোচনা করছি।

  • ওজন কমানোর প্রথম ধাপ হলো জীবনধারায় কিছু পরিবর্তন আনা। এর মধ্যে সামগ্রিক জীবনের শৃঙ্খলাবোধ, খাদ্য গ্রহণে ইতিবাচক পরিবর্তন এবং নিয়মিত দৈহিক পরিশ্রম করা অন্যতম।
  • মিষ্টিজাতীয় খাদ্য যতটা সম্ভব কম খাবেন।
  • চা পান করলে এক চামচের বেশি চিনি দেবেন না।
  • নিয়মিত খাদ্যতালিকায় কম ক্যালারি প্রদান করে এমন খাদ্য বেশি রাখুন। এরকম খাদ্যগুলো হলো: শাকসবজি, কাঁচা টক ফল ইত্যাদি। যারা ইতোমধ্যে স্থূলকায় হয়ে গেছেন, তাদের বেলায় ভাত, রুটি, মাছ, মাংস ইত্যাদি শাকসবজি দিয়ে প্রতিস্থাপন করতে হবে আগে।
  • ওজন কমাতে গিয়ে কখনোই খুব বেশি তাড়াহুড়ো করা উচিত হবে না। কারণ তাড়াহুড়ো করে ওজন কমিয়ে কিছুদিন পর আবার ওজন বৃদ্ধি পেলে তা আগের তুলনায় বেশি ক্ষতির কারণ হবে; আর অতিদ্রুত দৈহিক ওজন কমানোর ফলে শরীরের বিপাক প্রক্রিয়ায় অসামঞ্জস্যতা দেখা দেবে।
  • উপাদেয় ও লোভনীয় খাদ্যগুলো প্রায় সব সময়ই বর্জন করতে হবে। যেমন: পোলাও, বিরিয়ানি, মোগলাই, কাবাব ইত্যাদি।

 

খাদ্যের ক্যালরি কমানোর সহজ উপায়গুলো

  • যথাসম্ভব বর্জন করুন ফাস্টফুড, কোমল পানীয়, ভাজা খাবার, তৈলাক্ত খাবার, নির্ধারিত খাবারের মাঝে মাঝে এটা-সেটা খাবার।
  • সেদ্ধ ডিম খাবেন।
  • দুধ, চিনি ছাড়া হলে চা/কফিতে কোনো বাধা নেই। কৃত্রিম চিনি ব্যবহার করা থেকে বিরত থাকুন।
  • রান্নায় বেশি পানি ব্যবহার করুন। তেল ও মসলা যতটা সম্ভব কম দেবেন। এ কাজে ননস্টিক পাত্র সহায়ক হতে পারে। ভুনা খাবার খাওয়া বাদ দেবেন। খাবারের শেষে মিষ্টি বা চিনিজাতীয় খাদ্য যতটা সম্ভব এড়িয়ে চলুন।
  • দই, নারিকেল, ঘি, ডালডা-এসব দিয়ে রান্না করবেন না।
  • দিনে ৬ থেকে ৮ গ্লাস পানি পান করুন। প্রতিবার খেতে বসার আগে ১ থেকে ২ গ্লাস পানি পান করুন।
  • বেশি করে শাকসবজি ও ফলমূল খাবেন। বেশি করে মাছ খাবেন। চামড়া ছাড়া মুরগির মাংস খাবেন এবং গরু-খাসির মাংস কম খাবেন। এতে স্থায়ীভাবে আপনার পেট ভরার অনুভূতি থাকবে।
  • খাবার সময় টিভি দেখা, খবরের কাগজ পড়া বা বন্ধুর সঙ্গে ও পরিবারের লোকজনের সঙ্গে গল্প করা থেকে বিরত থাকুন। সরবর্জিত দুধ পান করবেন।
  • উচ্চ ক্যালরির খাবারগুলো বাদ দিয়ে নিু ক্যালরির খাবার খাবেন।

 

প্রতিদিনের দৈহিক শ্রম

  • দিনে কমপক্ষে ৩০ মিনিট শরীরচর্চা করার চেষ্টা করুন। একটানা ৩০ মিনিট সম্ভব না হলে দুই বা তিনবারে তা করুন।
  • এমন কিছু দিয়ে শুরু করুন, যা আপনার জীবনধারার সঙ্গে মানিয়ে যাবে। হাঁটা সবচেয়ে ভালো। বিকল্প হিসাবে ২০ থেকে ৩০ মিনিট সাঁতার কাটা, সাইকেল চালানো, ব্যাডমিন্টন বা টেনিস খেলার কথা চিন্তা করতে পারেন।
  • শারীরিক শ্রমের বেলায় নিয়মতান্ত্রিকতা মেনে চলার চেষ্টা করুন।
  • নিজের কাজগুলো নিজে করার চেষ্টা করুন। বাগান করা, গাড়ি বা ঘর পরিষ্কার করা, কাপড় ধোয়া বা অন্যান্য কাজ করার অভ্যাস করুন।
  • অফিসে যাওয়ার সময় হাঁটার অভ্যাস করুন এবং অফিস বা বাসার লিফট ব্যবহার না করে হেঁটে ওঠার চেষ্টা করুন।

 

ডা. শাহজাদা সেলিম

সহযোগী অধ্যাপক (এন্ডোক্রাইনোলজি ও মেটাবলিজম), বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়

 


আরও দেখুন: