অধ্যাপক ডা. সায়েবা আক্তারের সফলতার গল্প

2020-12-11 23:14:20
অধ্যাপক ডা. সায়েবা আক্তারের সফলতার গল্প

অধ্যাপক ডা. সায়েবা আক্তারে। ফাইল ছবি

অধ্যাপক ডা. সায়েবা আক্তার।  দেশের স্বনামধন্য গাইনোকোলজিস্ট ও সফল উদ্যোক্তা তিনি।  তাঁর আবিষ্কৃত সায়েবা'স মেথড নামে একটি নতুন চিকিৎসা পদ্ধতি ইতিমধ্যেই বিশ্বব্যাপী সাড়া জাগিয়েছে।  যার ফলে প্রথম কোনো নারী চিকিৎসক হিসেবে এই আবিষ্কারের স্বীকৃতিস্বরূপ এ বছর 'একুশে পদকে ভূষিত হয়েছেন তিনি। তাঁর আবিষ্কৃত এই চিকিৎসা পদ্ধতির মাধ্যমে নারীরা প্রসব পরবর্তী রক্তক্ষরণ জাতীয় সমস্যা থেকে মুক্তি পাচ্ছে।  তাছাড়া তিনি ইন্টারন্যাশনাল গাইনোকোলজিস্ট ফিস্টুলা সোসাইটি অব সার্জনের নির্বাচিত প্রেসিডেন্ট।  ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের গাইনি বিভাগের প্রধান ছিলেন অধ্যাপক ডা. সায়েবা আক্তার। চাকরি থেকে অবসরের পর রাজধানীর মগবাজারে ‘মামস ইন্সটিটিউট অব ফিস্টুলা অ্যান্ড ওমেনস হেলথ’ নামের একটি চিকিৎসালয় প্রতিষ্ঠা করেন। গরিব দুস্থ ফিস্টুলা রোগীদের এখানে তিনি পরম মমতায় চিকিৎসা করেন। প্রসূতির মৃত্যু এখনও উন্নয়নশীল দেশগুলোতে বড় একটি সমস্যা। আর এই মৃত্যুর প্রধান একটি কারণ রক্তক্ষরণ।  আজ থেকে ১৭ বছর আগে অত্যন্ত অল্প খরচে সহজ একটি পদ্ধতিতে প্রসূতির রক্তক্ষরণ বন্ধের উপায় বাতলে দিয়েছিলেন গাইনির ওপর বাংলাদেশের প্রথিতযশা চিকিৎসক ডা. সায়েবা আক্তার। ক্যাথেটার দিয়ে একটি কনডম প্রসূতির জরায়ুর ভেতর ঢুকিয়ে তা বাতাস দিয়ে ফুলিয়ে রক্ত বন্ধ করতে তাঁর আবিষ্কৃত এই পদ্ধতি এখন বিশ্বের বহু দেশে অনুসরণ করা হচ্ছে। সারা বিশ্বে প্রতি দুই মিনিটে একজন করে প্রসূতি মায়ের মৃত্যু ঘটছে সন্তান জন্ম দিতে গিয়ে। এর ৩০ শতাংশের জন্য দায়ী প্রসবকালীন রক্তক্ষরণ। এই চিরাচরিত ভয়ঙ্কর চিত্রটি বদলে দিতে বিস্ময়কর অবদান রাখেন বাংলাদেশের চিকিৎসক অধ্যাপক ডা. সায়েবা আক্তার।‘সায়েবাস মেথড’ নামের এই পদ্ধতি আজ অজস্র নারীর জীবন বাঁচানোর এক মোক্ষম উপায় হিসেবে স্বীকৃত হচ্ছে বিশ্বজুড়ে।  দেশের কিংবদন্তি এ মহান চিকিৎসকের সাক্ষাৎকার নিয়েছেন ডা. সাকলায়েন রাসেল।  অনুলিখন করেছেন আজাদ আশরাফ

ডক্টর টিভি: কেমন আছেন?

অধ্যাপক ডা. সায়েবা আক্তার: আলহামদুলিল্লাহ ভালো আছি।  

ডক্টর টিভি: আপনি আপনার আবিষ্কৃত সায়েবা'স মেথডের জন্য একুশে পদকে ভূষিত হয়েছেন।  এ বিষয়ে আপনার অনুভূতি জানতে চাই। 

অধ্যাপক ডা. সায়েবা আক্তার: আসলেই ওই মুহূর্তের কথা ভাষায় প্রকাশ করার মতো না।  আমি অনেক আনন্দিত।  সাথে সাথে কৃতজ্ঞতার বোঝা আরো বেড়ে গেল। পৃথিবীতে আজ পর্যন্ত অনেক পদক পেয়েছি।  কিন্তু এই পদক এর জন্য আমি মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর কাছে বিশেষভাবে কৃতজ্ঞ।  সর্বোপরি সবসময় মহান আল্লাহ তা'লার কাছে কৃতজ্ঞতা এবং শুকরিয়া জ্ঞাপন করছি। 

তাছাড়া এই পদক পাওয়ার পেছনে অনেক মানুষের অবদান রয়েছে।  যারা আমাকে নানাভাবে সহযোগিতা করেছে।  তাদের সবার কাছে আমি কৃতজ্ঞ।  বিশেষ করে সেসব রোগীদের কাছে যারা না হলে আমার গবেষণা কাজ চালিয়ে যাওয়া সম্ভব হতো না।  আমার ইচ্ছা হয় আমি তাদেরকে জনে জনে গিয়ে ধন্যবাদ জানাই।  আজ ডক্টর টিভির মাধ্যমে সবাইকে ধন্যবাদ জানাচ্ছি।

ডক্টর টিভি: সায়েবা'স মেথড সম্পর্কে একটু জানতে চাই।  এটি আসলে কী?

অধ্যাপক ডা. সায়েবা আক্তার: এটি একটি খুব সাধারণ চিকিৎসা পদ্ধতি। সাধারণ কিছু জিনিস যেমন কনডম- যা দেশে-বিদেশে, শহরে বা গ্রামে-গঞ্জে সবখানে পাওয়া যায়। এমনকি এখন মুদির দোকানেও পাওয়া যায়। এই কন্ডমের সাথে একটি টিউব বেধে দিয়ে প্রসবের পরে যখন এটি জ্বরায়ুর ভেতরে স্থাপন করে ফুলিয়ে দেওয়া হয় তখন রক্তক্ষরণ অনেকটা বন্ধ হয়ে যায়। 

কারণ এই রক্তক্ষরণ বাংলাদেশসহ সারা বিশ্বের একটি প্রধান সমস্যা। যা নিয়ে আমরা প্রতিনিয়ত যুদ্ধ করে যাচ্ছি। আর এই সায়েবা'স মেথডের এই জিনিসটি দাম পড়ে মাত্র একশ টাকা। কিন্তু বিদেশে কিছু বেলুন পাওয়া যায়। যেগুলোর দাম পড়ে ৩০০ ডলার। যেগুলো আমাদের ক্রয় ক্ষমতার বাইরে।

ডক্টর টিভি: এতো কিছু থাকতে এই পদ্ধতির কথা কিভাবে মাথায় আসলো এবং কিভাবে এই পদ্ধতিটা আবিষ্কার করলেন?

অধ্যাপক ডা. সায়েবা আক্তার: প্রসবের পর রক্তক্ষরণটা আমার কখনো গ্রহণযোগ্য ছিল না।  আমাদের কাছে আসা অনেক রোগী আমাদের চোখের সামনে মারা যেত। এমনও হয়েছে যে, ডাক্তারের কাছে হেঁটে হেঁটে আসলো আর লাশ হয়ে ফেরত গেল।  এটা আমি মানতে পারতাম না।  এটি নিয়ে ছোটকাল থেকে ট্রেইনিং পেয়ে আসছি। আমরা যখন ২০০০ সালে ঢাকা মেডিকেলের প্রফেসর তখন রিচার্ড জনসন নামে একজন ইংল্যান্ডের কনসাল্টেন্ট ট্রেনিং দিতে এসেছিলেন।  ওই ট্রেনিংয়ে কিছু বেলুন নিয়ে আসে।  তখন আমরা মডেলের ওপরে একটা ট্রেনিং দেই যে, কিভাবে এটি দিয়ে রক্তক্ষরণ বন্ধ করা যায়! 

তখন ওনারা যাওয়ার সময় আমি একটা বেলুন চেয়ে রেখে দেই।  যদিও এটি একবার ব্যবহারের উপযুক্ত তবুও এটিকে পরিষ্কার করে নিজেদের পদ্ধতিতে আমরা বারবার ব্যবহার করছিলাম।  এতে আমরা কিছু মায়ের জীবন রক্ষা করতে পেরেছি; কিন্তু একটা সময় এটি হারিয়ে যায় আর তার ঠিক পরের দিন আঠার বছরের একটা মেয়ে রক্তক্ষরণ হতে হতে আমাদের চোখের সামনেই মারা যায়। তখন খুব অস্থির লাগছিল যে, আজ যদি ওরকম বেলুন থাকতো তাহলে মেয়েটাকে বাঁচানো যেত! তখন মাথায় আসলো গ্রামেগঞ্জে বাচ্চারা দোকান থেকে কনডম কিনে বেলুন ফুলিয়ে খেলা করে। এটি তো মেডিকেল এলিমেন্ট। এটি যদি কিছু দিয়ে ফুলানো যায় তাহলে এটি ব্যবহার করে কিছু মায়ের জীবন বাঁচানো যাবে। 

তার একদিন পর আমি সিজার রোগীদের দরজার সামনে দাঁড়িয়ে জিজ্ঞেস করছিলাম যে, ওখানে কী হচ্ছে! তখন একজন সিস্টার বলল একজন মায়ের কোনভাবে রক্তক্ষরণ বন্ধ করা যাচ্ছে না।  তখন ফ্যামেলি প্লানিং অফিস থেকে একটা কনডম নিয়ে আসতে বললাম।  যখন কনডমটি ইউটাসের ভেতরে ঢুকিয়ে স্যালাইন দিয়ে ফুলিয়ে দিলাম তখনই রক্তক্ষরণ বন্ধ হয়ে যায়।  আর আমরা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলি। এভাবেই আসলে এটি আবিষ্কারের সূচনা হয়।

ডক্টর টিভি: বছর দেড়েক আগে কেনিয়ার একটি হসপিতালে একজন চিকিৎসক আপনার এই পদ্ধতি ব্যবহার করে ছয়জন নারীর জীবন বাঁচিয়েছিল।  এটি নিয়ে 'বিবিসি ওয়ার্ল্ড হ্যাকস' নামে একটা অনুষ্ঠানে খুব বেশি মাতামাতি করেছিল। তারা এটি কেনিয়ার ওই চিকিৎসকের আবিষ্কার বলে ফলাও করে নিউজ করেছিল।  কিন্তু আসল ব্যাপারটা বিশ্ববাসীর কাছে জানানোর জন্য আপনার স্টুডেন্টরা প্রতিবাদ করে।  আর সেই সাথে আমাদের দেশের সাংবাদিকরাও অনেক প্রচেষ্টা চালায় এবং শেষ পর্যন্ত লেগে থেকে আপনার আবিষ্কারের কথাটি বিশ্ববাসীর কাছে তুলে ধরতে সক্ষম হয়।  এই সাংবাদিকদের ভূমিকার ব্যাপারে আর পুরো বিষয়টা নিয়ে আপনার মন্তব্য কী? 

অধ্যাপক ডা. সায়েবা আক্তার: অবশ্যই এই আবিষ্কার বিশ্ববাসীর সামনে নিয়ে আসার পেছনে সাংবাদিকরা অনেক বড় ভূমিকা রেখেছে।  আমি তাদেরকে অন্তর থেকে ধন্যবাদ ও কৃতজ্ঞতা জানাই।  তাছাড়া আমি যখন আমি একুশে পদক পাই তখন এক সাংবাদিক আমাকে সাথে সাথে ফোন করে অনুভূতি জানতে চাই।  এই ব্যাপারটি আসলেই আমার জন্য অনেক আনন্দদায়ক ছিল। 

আর আমি এই পদ্ধতি নিয়ে কাজ করার পর অনেক দেশ থেকে আমাকে ইনভাইট করা হয়েছিল এবং গিয়েছিও।  এই ব্যাপারে অনেক দেশে লেকচার দিয়েছি এবং হাতে কলমেও শিখিয়েছি।  বিবিসি কেন এমন করল আমি আসলে বুঝতে পারছি না।  আমি দক্ষিণ আফ্রিকা, কেনিয়াসহ অনেক দেশে গিয়েছি।  এমনকি পিগুর মত ইন্টারন্যাশনাল একটি সংস্থাও আমাকে ইনভাইট করেছে।

আর শেষ পর্যন্ত আমাদের ছাত্র আর সাংবাদিকরা এই পুরো বিষয়টি সবার সামনে নিয়ে আসলো আর বিশ্ববাসীর কাছে উপস্থাপন করল। তবে বিবিসি পরে এই বিষয়টি নিয়ে দুঃখ প্রকাশ করেছে।

ডক্টর টিভি: অনেক চিকিৎসকরা নারীদের এই ফিস্টুলা রোগ নিয়ে কাজ করতে চান না। কিন্তু আপনি এই বিষয়টি নিয়ে খুব বেশি আগ্রহী ছিলেন এবং এগিয়ে আসলেন।  আর খুব সম্ভবত ন্যাশনাল ফিস্টুলা সেন্টার গড়ার পেছনে আপনার অনেক অবদান আছে। এর পেছনের গল্পটি কী ছিল?

অধ্যাপক ডা. সায়েবা আক্তার: আমি যখন ট্রেনিংয়ে ছিলাম তখন আমার ম্যাম ছিলেন ডা. সুরাইয়া জাবিন।  তিনি তখন ফিস্টুলা অপারেশন করতেন। আমি তখন অপারেশন বুঝতাম না।  কিন্তু অপারেটিভ কেয়ার দিতে গিয়ে রোগীদের খুব সামনে থেকে দেখার সুযোগ হয় আর তখন তাদের কষ্টটা অনুধাবন করতে পারি।  আর মনে মনে ভাবতে থাকি যদি সুযোগ পাই তাহলে এদের জন্য কিছু করব। 

মাঝখানে নিজের ক্যারিয়ার করতে গিয়ে অনেকদিন এটি মনে ছিল না।  বরিশালে যখন আমি প্রফেসর ছিলাম তখন আমি এই ডিপার্টমেন্টের ইনচার্জ হই।  তখন ওই রোগীগুলোকে দেখে মনে হলো আমি তো একদিন প্রতিজ্ঞা করেছিলাম তাদের জন্য কিছু করব।  তখন আমি বরিশালের একমাত্র প্রফেসর হওয়ায় আমার খুব নামধাম ও বলা যায় এক ধরনের কর্তৃত্বও ছিল।  তখন আমি আটটা বেডকে একত্রিত করে এক জায়গায় ফিস্টুলা করা শুরু করি।

বলতে গেলে আমার ফিস্টুলার প্রশিক্ষণ জীবন শুরু হয় বরিশাল থেকে।  আমি সার্জিক্যাল বই পড়ে পড়ে চিন্তা করতাম।  দেখতাম যে, কোথায় সেলাই করলে ভালো হবে।  মূলত ওদের ট্রিটমেন্ট করতে করতেই আমার দক্ষতা বাড়তে থাকে।  আর ওখান থেকেই ফিস্টুলার প্রতি আকর্ষণ বৃদ্ধি পায়।

ডক্টর টিভি: আমরা জানি, একজন রোগী আসা-যাওয়া ও থাকা-খাওয়াসহ সব খরচ আপনি বিনামূল্যে দিচ্ছেন।  এটি আসলে কীভাবে সম্ভব হচ্ছে?

অধ্যাপক ডা. সায়েবা আক্তার: প্রথম যখন আমি শুরু করি তখন আমাকে অনেকে উৎসাহিত করেছে আবার অনেকে অনুৎসাহিত করেছে।  অনেকে বলত এটি করা সম্ভব না।  কিন্তু আমার একটা দৃঢ় বিশ্বাস ছিল যে, যদি আমার নিয়তটি সহীহ হয় তখন আমি অবশ্যই আল্লাহর কাছ থেকে সাহায্য পাব আর সেই সাহায্যটা বিভিন্ন মানুষের মাধ্যমে আমি পেয়েছিও।  আমি রিটায়ার্ডমেন্টের পরে প্রভিডেন্ট ফান্ডের যে টাকাটা পেয়েছি সেই টাকাটা দিয়ে আমি এটি শুরু করি।  তবে টাকা পর্যাপ্ত ছিল না সেজন্য আমার একটু সময় লেগেছে।  আর মাসিক যা টাকা পেয়েছি তা এখানে খরচ করেছি।  তাই কাজটা ২০১০ সালে শুরু করে ২০১২ সালের ডিসেম্বরে শেষ করতে পারি। এভাবে মাম'স ইন্সটিটিউট অব ফ্রিস্টুলা এন্ডোমেন্টস প্রতিষ্ঠা হয়।  এটির আগে তার নিচে তাকওয়া হাসপাতালে সাতটা বেড ভাড়া করে আমরা ওখানে কাজ শুরু করি।

ডক্টর টিভি: আপনার এই ইন্সটিটিউট নিয়ে আপনার ভবিষ্যত পরিকল্পনা কী?

অধ্যাপক ডা. সায়েবা আক্তার: যদিও আমরা এই ইন্সটিটিউটে বিনামূল্যে চিকিৎসা করেছি কিন্তু এই রোগের চিকিৎসার জন্য দক্ষ জনবলের দরকার।  আর তাছাড়া রোগিদের চিকিৎসার পাশাপাশি আমরা ডাক্তারদেরকেও প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করি।  কিন্তু আমাদের সম্বল কম কিন্তু ইচ্ছা অনেক।  তাই আমরা যদি সরকারের সহযোগিতা পাই তাহলে এই ইন্সটিটিউটকে আরো বড় আকারে করে রোগীদের আরো সেবা দিতে পারবো আর সেই সাথে চিকিৎসকদেরকেও প্রশিক্ষণ দিতে পারবো। 

ডক্টর টিভি: যারা বিত্তবান আছেন তারা যদি এটি নিয়ে কাজ করতে চান বা এটিকে প্রমোট করতে চান তাদের উদ্দ্যেশে কী বলবেন?

অধ্যাপক ডা. সায়েবা আক্তার: অবশ্যই যারা এটি নিয়ে কাজ করতে চান তাদের আমি ধন্যবাদ জানাই।  সমাজের বিত্তবান আর সরকারের প্রতি আর অনেক হৃদয়বান মানুষ আছেন যারা এগিয়ে আসতে চান তাদের প্রতি আমার আবেদন আপনারা এগিয়ে আসুন।  কারণ আমাদের এই ইন্সটিটিউটকে সাহয্য করা মানে আমাদের মায়েদেরকে সাহায্য করা।  আমরা মায়েদের গর্ভে জন্ম গ্রহণ করেছি আর আমাদের সবচেয়ে প্রিয় ব্যাক্তিত্বও আমাদের মা। তাই আমাদের এই মায়েদের বাঁচাতে এগিয়ে আসুন।

ডক্টর টিভি: আমরা জেনেছি গাইবান্ধা আর ঢাকায় আপনার কিছু প্রজেক্ট আছে।  সে সম্পর্কে যদি কিছু বলতেন।

অধ্যাপক ডা. সায়েবা আক্তার: এই প্রজেক্টে আমি যারা দরিদ্র, অসহায়, অনাথ, ছিন্নমূল ইত্যাদি সেসকল মেয়েদেরকে আমি প্রথমত লেখাপড়া শেখাই। আর সেই সাথে অনেককে সেলাইসহ নানা হাতের কাজ শেখাই।  আমবাগানে মেয়েদের একটা হোস্টেল করেছি।  যদিও আগে ছিল না।  মেয়েদের নিরাপত্তার কথা চিন্তা করে আমাদের পারিবারিক সহায়তায় এখন করা হয়েছে।  গাইবান্ধায় একটা মাদ্রাসায় একটা হোস্টেল করে দিয়েছি।  তারা এই মাদ্রাসায় পড়াশোনা করে।  আর সকল খরচ আমি বহন করি। আমি মাঝে মাঝে গিয়ে তদারকি করি।

ডক্টর টিভি: আপনার শিক্ষা ও কর্মজীবন নিয়ে জানতে চাই।

অধ্যাপক ডা. সায়েবা আক্তার: আমার একাডেমিক পড়াশোনা শুরু হয় টাঙ্গাইলের বিন্দুবাসিনী বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ে।  সেখানে কিছুদিন পড়ার পর আব্বু করোটিয়া সাদাত কলেজের প্রফেসর হওয়ায় আমরা সেখানে চলে যাই।  আর সেখানে একটা আবিদা খানম বালিকা বিদ্যালয় নামে একটা নতুন স্কুল থেকে আমি এসএসসি পাস করি। আর এইচএসসি পরিক্ষা দিই করোটিয়া সাদাত কলেজ থেকে।  আর চান্স পেয়ে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজে ভর্তি হয়ে এমবিবিএস পাস করি। 

আর পেশাগত জীবনের শুরুতে আমি চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজের প্যাথলজি ডিপার্টমেন্টের লেকচারার হিসেবে কিছুদিন শিক্ষকতা করি।  তারপর পোস্ট গ্রাজুয়েশন তথা এফসিপিএস করার জন্য আইপিজিয়াম তথা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান মেডিকেল কলেজে ভর্তি হই।  সেখান থেকে এফসিপিএস পার্ট ওয়ান শেষ করার পর মিডফোর্ড স্যার সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজে ট্রেনিং করি।  আর ট্রেনিং শেষে বাংলাদেশ কলেজ অব ফিজিশিয়ান অ্যান্ড সার্জন থেকে এফসিপিএস সম্পন্ন করি।  সর্বশেষ ঢাকা মেডিকেলের বিভাগীয় প্রধান ছিলাম। 

ডক্টর টিভি: ঢাকা মেডিকেলের অভিজ্ঞতাটা কেমন ছিল?

অধ্যাপক ডা. সায়েবা আক্তার: ঢাকা মেডিকেল কলেজ আমার জীবনের জন্য বিশাল একটা অধ্যায় ছিল।  এটি আমার জীবনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে।  কারণ আমি প্রায় আট বছর আইপিজিয়ামে কাজ করেছি। এখানে এসে আমি খুব উপভোগ করেছি। কারণ এখানে খুব অল্প সম্বলের উপর বেশি মানুষকে সেবা দেওয়া যেত।  আর তাছাড়া ঢাকা মেডিকেলে না গেলে হয়ত সায়েবা'স মেথড টা আবিস্কার করতে পারতাম না! 

আর ন্যাশনাল ফিস্টুলা সেন্টারের উদ্যোগটাও আমি ঢাকা মেডিকেল কলেজ থেকেই শুরু করি।  প্রথমে আমি অনেকে দ্বারে দ্বারে ঘুরেছি এই ফিস্টুলা সেন্টার খোলার জন্য। পরে সরকারি উদ্যোগে এই ফিস্টুলা সেন্টারটি এখন পর্যন্ত পরিচালিত হচ্ছে। আর আমি মাঝে মাঝে ভাবি এটি আমার আরেকটি সন্তান।

ডক্টর টিভি: আপনার পারিবারি জীবনের গল্প বলুন।

অধ্যাপক ডা. সায়েবা আক্তার: আমার চার সন্তান।  তিন মেয়ে ও এক ছেলে।  বড় মেয়ে চিকিৎসক।  ও নিজের ইচ্ছাতেই চিকিৎসক হয়েছে। অন্যরা চিকিৎসক হয়নি।  কারণ তারা তাদের মাকে যেভাবে মিস করেছে সেভাবে তাদের বাচ্চাদেরও মিস করতে দিতে চায়নি।  সেজন্য তারা চিকিৎসক হয়নি। যদিও এখন তারা মাকে নিয়ে গর্ববোধ করে।  কিন্তু ওই সময়টা তারা আমাকে খুব মিস করতো।  দ্বিতীয় মেয়ে ব্যাংকার।  আমার ছেলেটা সুপ্রিম কোর্টের ব্যারিস্টার।  আর ছোট মেয়ে কানাডার একটি ইউনিভার্সিটিতে পাবলিক পলিসিতে মাস্টার্স করছে। 

আর আমার ছেলেমেয়েদের সাথে আমার সম্পর্ক বন্ধুত্বপূর্ণ ছিল।  যদিও আমাকে ভয় পেতো তবুও আমার সাথে মাঝে মাঝে দুষ্টুমি করতো।  তারা বলতো তুমি আমাদের কত কম সময় দাও তবুও আমরা লাকি! 

তবে আমি সবার সমানভাবে খোঁজখবর রাখার চেষ্টা করতাম। সবার সুবিধা-অসুবিধা ও প্রয়োজগুলোর প্রতি খেয়াল রাখতাম।

আমার স্বামী একজন কিডনি স্পেশালিস্ট।  নিউ ন্যাশনাল কিডনি ইন্সটিটিউটের পরিচালক ছিলেন।  ওখান থেকেই উনি অবসর গ্রহণ করেন।  স্বামী হিসেবে আমি বলব এতো সহযোগী স্বামী আমি দ্বিতীয় দেখিনি।  কোনো কাজে তিনি কখনো না বলেননি।  সব কাজেই তিনি পরামর্শ দেওয়ার চেষ্টা করেছে যে, কিভাবে আমি আরো ভালোভাবে কাজ করতে পারবো।  আর তিনি আমাদের বাচ্চাদের প্রতি খুব কেয়ারিং ছিলেন। আমি কিছু সময় কম দিতে পারলে তিনি সেটা ব্যালান্সড করার চেষ্টা করতেন। 

বিশেষ করে তিনি লেখাপড়ার বিষয়টা খুব ভালভাবে দেখতেন।  আর আমি তাদের জীবনগড়ার মন্ত্রগুলোর বলার চেষ্টা করতাম।  কখনো খাবার টেবিলে বসে কখনো টেলিভিশন দেখতে দেখতে আমি তাদের ভালো-মন্দের পার্থক্য বুঝাতাম।  কোনটা উচিত কোনটা অনুচিত তা নিয়ে বলার চেষ্টা করতাম।  যাতে তারা নৈতিকভাবে পদস্খলন না হয়।  আমার ছেলে ৬ বছর বয়সে কানাডায় পড়াশোনা করতে যায়।  তার সাথে আমি প্রতিরাতে প্রায় ৪৫ মিনিট কথা বলতাম।  সে বলতো আমার বন্ধুরা সবাই নষ্ট হয়ে গেছে।  কিন্তু তোমার এই একটা ফোন যা আমাকে সেই নষ্ট কাজ থেকে বাঁচিয়ে রেখেছে।  কারণ তারা আমাকে এখানে-সেখানে যেতে বলতো কিন্তু আমি চিন্তা করতাম ওই সময়ে যদি তুমি ফোন কর তাহলে আমি কী উত্তর দেব!

ভিডিওতে শুনুন অধ্যাপক ডা. সায়েবা আক্তারের পুরো সাক্ষাৎকার


আরও দেখুন: