ক্লিনিক্যাল গবেষণার জন্য বাংলাদেশ বিশাল কেন্দ্রভূমি হতে পারে: ডক্টর টিভিকে অধ্যাপক প্রাণ গোপাল
অধ্যাপক প্রাণ গোপাল দত্ত। ফাইল ছবি
স্বাধীনতার পর থেকেই দেশের স্বাস্থ্যসেবা নিয়ে বিশেষ ভাবনা ছিল জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের। বঙ্গবন্ধু চেয়েছিলেন, চিকিৎসকদের পোস্ট গ্রাজুয়েশন বা বিদেশ থেকে ট্রেনিং করে আনানো, তাদের উচ্চশিক্ষার প্রতি সব সময় তিনি আগ্রহী ছিলেন।কারণ তিনি জানতেন আমাদের ডাক্তাররা যত অভিজ্ঞ হবে, আমাদের স্বাস্থ্যসেবা তত উন্নত হবে, তত সুন্দর হবে। এ বিষয়ে ডক্টর টিভিকে দেয়া বিশেষ সাক্ষাৎকার দিয়েছেন দেশের স্বনামধন্য চিকিৎসক ও বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় (বিএসএমএমইউ)-এর সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক ডা. প্রাণ গোপাল দত্ত। সাক্ষাৎকারে তিনি বলেছেন স্বাস্থ্যসেবায় বঙ্গবন্ধুর স্বপ্ন নিয়ে। বলেছেন বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে তাঁর দেখা হওয়ার স্মৃতি। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন ডা. তানিয়া রহমান মিতুল
ডক্টর টিভি: স্যার, বঙ্গবন্ধুর স্বাস্থ্যসেবা নিয়ে কী ধরণের চিন্তাভাবনা ছিল? সে বিষয়ে কিছু বলুন।
অধ্যাপক ডাক্তার প্রাণ গোপাল দত্ত: আমি আমার কথার শুরুতেই ইতিহাসের যে মহানায়ক, বাঙালি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু ১৫ আগস্ট শাহাদাতবরণ করেছিলেন। উনাকে সহ অন্যান্য পরিবারের অন্যান্য সদস্যরা যারা শাহাদাত বরণ করেছিলেন তাদের সবার প্রতি গভীর শ্রদ্ধা জানিয়ে আমার কথা শুরু করছি।
আমি আশ্চর্য হয়ে যাই একটা জিনিস দেখে,পলিটিক্যাল শব্দের সাথে দুইটা শব্দ কিন্তু কমনলি আসে একটা পলিটিক্যাল সাইন্স আর একটা পলিটিকাল ফিলোসফি। তৃতীয় যেটা আসে সেটা হচ্ছে পলিটিক্যাল ইকোনমিক্স। বঙ্গবন্ধু এই তিনটা বিষয়ের ওপরই সমান দক্ষতা রেখেছিলেন এবং রেখেছিলেন বলেই ৭২ সালে দেশে ফিরে এসে ডাক্তারদের বিদেশে যাওয়ার ওপর এম্বারগু (নিষেধাজ্ঞা) দিলেন। আমার বাংলাদেশের ডাক্তাররা বিদেশে যেতে পারবে না, কিছু কিছু ডাক্তাররা হয়তো গেছে পড়ালেখা করার জন্য, নাম বদলে পাসপোর্ট করে গেছে। কিন্তু ডাক্তারদের বিদেশে যাওয়াটা প্রথম নিষেধ করেছিলেন বঙ্গবন্ধু। কারণ, ডাক্তাররা চলে গেলে রোগীরা চিকিৎসা পাবে কোথায়?
আরেকটা জিনিস বিখ্যাত অর্থোপেডিক সার্জন আরজেগাস্টকে আনা এবং একজন প্লাস্টিক সার্জন লুদিয়ানা থেকে এসেছিল পারভেজ বেজলি। এদেরকে দিয়ে যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধাদের চিকিৎসার ব্যবস্থা যে উনি করেছিলেন, এটাতো ওনার দর্শন না থাকলে সম্ভব হতো না।
তৃতীয় যে কথাটা আমি বলবো সেটা হল, তখন অর্থোপেডিক সার্জারির কিছু ডাক্তারকে তিনি পূর্ব জার্মানিতে পাঠিয়েছিলেন বার্লিনে এবং সেখান থেকে তাদের প্রশিক্ষণ দিয়ে দেশে এনে যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধাদের চিকিৎসা দেওয়ার কাজে নিয়োজিত করেছিলেন। উনি সমাজতান্ত্রিক অর্থাৎ ইস্ট ইউরোপীয় দেশগুলোতে রাষ্ট্রীয় খরচে অথবা ওইসব দেশের সাহায্যে চিকিৎসা করানোর ব্যবস্থা করেছিলেন।
আর সবচেয়ে মজার ব্যাপার হলো-পাকিস্তান আমলে আমরা জানি থানা হেলথ সেন্টার ছিল। উনি প্রথম যেটা করলেন ইউনিয়ন পর্যায়ে হেলথ এবং ফ্যামিলি ওয়েল ফেয়ার সেন্টার খুলে দিলেন। আর মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন যে, কমিউনিটি ক্লিনিকটা বঙ্গবন্ধুর স্বপ্ন। একচুয়ালি মাননীয় প্রধানমন্ত্রী আমাকেও বলেছেন যে এটা বঙ্গবন্ধুর দর্শন ছিল। এখন আপনারা সবাই জানেন, আমরা সবাই জানি, মাননীয় প্রধানমন্ত্রী কিন্তু বারবার বলেন আমি শুধু বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নটা বাস্তবায়ন করছি উনার যে সোনার বাংলা গড়ার স্বপ্ন ছিল সেটা করছি।
ডক্টর টিভি: বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে কি কখনও আপনার সরাসরি সাক্ষাৎ হয়েছিল? হয়ে থাকলে ওই স্মৃতিটুকু আমরা শুনতে চাই।
অধ্যাপক ডা. প্রাণ গোপাল দত্ত: আমার সাথে সরাসরি বঙ্গবন্ধুর একটা সাক্ষাৎকার হয়েছিল, সেটা হয়েছিল ১৯৭৩ সালের ৯ মার্চ। সেটা ৭ মার্চ স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। সে নির্বাচনে আমি টাঙ্গাইলের কালিহাতী নির্বাচনী কেন্দ্রে আব্দুল লতিফ সিদ্দিকীর পক্ষে নির্বাচন করার জন্য যাই আমি তখন চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজের থার্ড ইয়ারের ছাত্র। সেখানে জাসদের প্রার্থী ছিলেন শাজাহান সিরাজ।
শাজাহান সিরাজের জন্য এবং গণবাহিনীর যতটা ছিল সবই কালিহাতীতে হাজির ছিল। আমরা চিটাগাং থেকে কয়েকজন এসেছিলাম লতিফ সিদ্দিকীর নির্বাচন করার জন্য। সে নির্বাচনে জয়ী হওয়ার পরে ৯ মার্চ দুপুরের পরে আমরা যখন ৩২ নম্বরে বঙ্গবন্ধুর সাথে দেখা করতে যাই। সেখানে গিয়ে দেখলাম জাতীয় প্রফেসর ডা. নুরুল ইসলামকে ডাকা হয়েছে বঙ্গবন্ধুর স্বাস্থ্য পরীক্ষা করার জন্য, বঙ্গবন্ধু তখন বললেন প্রফেসর সাহেব আমার কিছু হয় নাই। এই যে আমার আশপাশে যারা আছে তারা আমাকে অসুস্থ বানানোর জন্য ব্যস্ত হয়ে ওঠে।
আরও মজার ব্যাপার হলো কি, ইসলাম স্যারকে অনেক বললেন, প্রফেসর সাহেব আপনি কি জিন্না পোস্ট গ্রাজুয়েট দেখেন নাই? স্যার তখন বললেন দেখবো না কেন, আমি তো সেখানে পরীক্ষা দিতে গিয়েছি। বঙ্গবন্ধু তখন বললেন, ‘জিন্না পোস্ট গ্রাজুয়েট যে মেডিকেল ইনস্টিটিউট আপনি দেখেছেন সেটার ক্যালিবার, সেটার স্থাপনা, স্থাপত্য এসব কিছু দেখে আপনি এই পিজি হাসপাতালটাকে এই হোটেল থেকে সরিয়ে সোহরাওয়ার্দী কমপ্লেক্সের আশেপাশে অথবা মহাখালীর পরে অথবা সাভারের দিকে কয়েকশ একর জায়গা নিয়ে কেন সেটা করছেন না?’
তাহলে এখান থেকে আপনি বুঝতে পারেন একটা নেতার অতঃপর বড় দূরদর্শিতা থাকলে এমন একটা কথা বলতে পেরেছিলেন।
ডক্টর টিভি: চিকিৎসকদের পোস্ট গ্রাজুয়েশনের বিষয়ে বঙ্গবন্ধুর পরিকল্পনা ও বর্তমান সরকারের পদক্ষেপ নিয়ে কিছু বলুন।
অধ্যাপক ডা. প্রাণ গোপাল দত্ত: বাংলাদেশ কলেজ অব ফিজিশিয়ানস সার্জন এটাও কিন্তু বঙ্গবন্ধুর আমলে একটা অর্ডিনেন্স দিয়ে হয়েছিল প্রথম। তারপর এই তদানীন্তন পিজি হাসপাতাল এটাও কিন্তু এই বঙ্গবন্ধুরই সৃষ্টি।
আমাকে যখন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম ট্রেজারার করা হয়। ১৯৯৯ এবং ২০০০ সালে আমি ছিলাম। তখন এখানে এক্সটেনশন করার মতো আমাদের এখানে কোন জায়গা ছিল না। আমাদেরকে যখন মাননীয় প্রধানমন্ত্রী তখন স্বাস্থ্যমন্ত্রী ছিলেন শেখ সেলিম সাহেব উনার মাধ্যমে শেরাটন হোটেলের উল্টো দিকের জায়গাটা দিলেন। আর আমি ভাইস চান্সলর হওয়ার পরে, নতুন যে একটা কোরিয়ার ইডিসিএফের আর্থিক সহায়তায় যে হাসপাতালটা হচ্ছে, যেটা এখন কনক দা (অধ্যাপক ডা. কনক কান্তি বড়ুয়া)-এর তত্ত্বাবধানে নির্মিত হচ্ছে। সেই হাসপাতালটা করার জন্য যে জায়গাটা সেই জায়গাটা কিন্তু বঙ্গবন্ধুর সুযোগ্য কন্যা আমাদের প্রিয় আপা জননেত্রী শেখ হাসিনার আনূকুল্য থাকার জন্য পেয়েছি। একই সাথে রাস্তার পূর্বধারে যে আমাদের বেতার কেন্দ্রটা আছে, সেটাও শেষ সময়ে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের এক্সটেনশনের জন্য আমাদের দিয়ে গেছেন।
এক কথায় বলতে গেলে-লাইক ফাদার লাইক ডটার, মানে বাবার যে স্বপ্ন বাবার মত যে একজন কন্যা এটা মাননীয় প্রধানমন্ত্রী প্রমাণ করে দিয়েছেন বারবার আমাদেরকে।
মাননীয় প্রধানমন্ত্রী কিন্তু ডাক্তারদের যেকোনো সমাবেশে গেলে একটা কথাই বলেন, ‘আপনাদের গবেষণা করতে হবে’। - এ কথাটা সত্যি বাংলাদেশ ক্লিনিক্যাল গবেষণার জন্য যে পরিমাণ ম্যাটারিয়াল আছে ল্যাবরেটরি ফ্যাসিলিটিজ দিন দিন আমাদের যে পরিমাণ উন্নতি হচ্ছে আমি দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি এটা গবেষণার একটা বিশাল কেন্দ্রভূমি হতে পারে। আর হয়েছেও।
আইসিডিডিআরবি তাদের এই গবেষণা করার জন্য বাংলাদেশকে বেশি নিয়েছিল কলেরা এবং ডায়রিয়া ডিজিজের জন্য। কারণ আমাদের এখানে এত রোগী আছে, গবেষণার পরিবেশ আছে পরিবেশ আছে। আমি বিশ্বাস করি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য এই গবেষণারটাকে আরও এগিয়ে নিয়ে যাবেন।
মেডিকেল শিক্ষাক্ষেত্রে আমূল পরিবর্তন কিন্তু আমরা এনে দিয়েছি। মেডিকেলের ভর্তি পরীক্ষার ক্ষেত্রে আগে যে জালিয়াতি হতো সেটা কিন্তু আমরা সম্পূর্ণরূপে বন্ধ করে দিয়েছি। এখন শুধুমাত্র মেধাবী ছেলেরা সেখানে ভর্তি হচ্ছে, এবং মেধার যোগ্যতা রেখে তারা স্নাতকোত্তর ডিগ্রি অর্জন করছে।
ডক্টর টিভি: সময় দেয়ার জন্য ধন্যবাদ।
অধ্যাপক ডা. প্রাণ গোপাল দত্ত: আপনাদেরও ধন্যবাদ।