ডায়াবেটিসে মাড়ির সমস্যা

ডক্টর টিভি রিপোর্ট
2024-08-01 13:51:00
ডায়াবেটিসে মাড়ির সমস্যা

দাঁতের মাড়িতে ইনফেকশন নিয়ে কথা বলছেন অধ্যাপক ডা. অরূপ রতন চৌধুরী

ডায়াবেটিস রোগের জন্য দাঁতের মাড়ি এবং হাড়ে (যা দাঁতকে যথাস্থানে রাখতে সাহায্য করে) ইনফেকশন হতে পারে। অন্যান্য ইনফেকশনের মত রক্তে গ্লুকোজের পরিমাণ বেড়ে গেলে দাঁতের মাড়িও আক্রান্ত হতে পারে। এই সমস্যাকে প্রতিরোধ করার জন্য বছরে অন্তত দু'বার ডেন্টিস্ট-এর শরণাপন্ন হওয়া উচিত এবং অবশ্যই ডাক্তারকে আপনার ডায়াবেটিস সম্পর্কে অবহিত করা প্রয়োজন। দিনে দু'বার দাঁত ব্রাশ ও ডেন্টাল ফ্লস দ্বারা পরিষ্কার করা এবং ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণ রাখা প্রয়োজন। উপায় ডায়াবেটিস রোগীদের দাঁতের সমস্যা থেকে মুক্তি পাবার এটাই প্রধান উপায় । অধিকতর খারাপ অবস্থা হলে ইনফেকশন দাঁতের মাড়িতে এমনকি হাড় (যা দাঁতকে যথাস্থানে রাখে) পর্যন্ত ছড়িয়ে যেতে পারে এবং এভাবেই দাঁত দূর্বল হয়ে নড়ে গিয়ে পড়ে যেতে পারে, বা একদিন মূল্যবান দাঁতকে জারাতে হতে পারে। লক্ষণসমূহ : .দাঁতের মাড়ি লাল হয়ে ফুলে যায়। • দাঁতের মাড়ি থেকে রক্ত পড়ে। • দাঁতের গোড়া থেকে মাড়ি সরে যাওয়ার কারণে দাঁতকে অস্বাভাবিক অবস্থান দেখা যায় । .যদি দাঁত নড়ে যায় সংবেদনশীল হয়ে পড়ে। . মুখে দুর্গন্ধ হয় । .দাঁতের কামড় অস্বাভাবিক অনুভূত হয় । .অকার্যকর ডেনচার (কৃত্রিম দাঁত) হয়। এই ধরনের কোন সমস্যায় ডেন্টিস্টের সাথে অবশ্যই পরামর্শ করা প্রয়োজন । ডায়াবেটিস রোগীদের জন্য পরামর্শ ও কিছু নির্দেশনা : ডায়াবেটিস রোগীদের মাড়ির প্রদাহ বেশি হওয়ার কারণ হলো- ১। দেহে ইনসুলিন ঘাটতি হলে আমিষেরও ঘাটতি হয় ফলে কোষকলার (Tissues) স্বাভাবিক বৃদ্ধি, সংস্কারও উৎপাদন ব্যাহত হয় তাই মুখের কোন স্থানে ঘা হলে ও প্রদাহ থাকলে শুকাতে বিঘ্ন ঘটে। দেহে রোগ প্রতিরোধ শক্তি কমে আসে ফলে দাঁতের গোড়ায় প্লাক জমা থাকলে সহজেই মাড়ির প্রদাহ শুরু হয়। ডায়াবেটিস রোগীদের দন্তক্ষয় বা ডেন্টাল ক্যারিজ রোগ হতে পারে তার কারণ হিসেবে বিজ্ঞানীরা উল্লেখ করেছেন। ক) মুখের লালার সাথে গ্লুকোজ-এর বাড়তি সংযোজনের ফলে ঐ গ্লুকোজ মুখে এক ধরনের অণুবীক্ষণিক জীবাণুর সাথে মিলে অম্ল বা এ্যাসিড তৈরি করে। এসিড দাঁতের শক্ত আবরণ এনামেলকে ক্ষয় করতে থাকে এবং ধীরে ধীরে দাঁতের ভেতরে গর্তের সৃষ্টি করে। খ) মুখের লালার স্বাভাবিক গতি ব্যহত হয় এবং পরিমণ কমে যায় ফলে মুখের অতিরিক্ত শুকনো পরিবেশে আহারের কণাগুলো ধুয়ে মুছে যেতে পারে না। এই খাদ্যকণাগুলো দীর্ঘদিন দাঁতের গায়ে ও মাড়ির ফাঁকে জমে থেকে দাঁতের ভেতরে গর্তের সৃষ্টি করে। প্লাক : মুখে খাদ্যকণা জমে থেকে যে আবরণ সৃষ্টি হয় এর নাম ডেন্টাল প্লাক । এই প্লাক লক্ষ লক্ষ অণুবীক্ষণিক জীবাণুর সমষ্টি। মুখের দুই প্রধান রোগ ডেন্টাল ক্যারিজ ও মাড়ির প্রদাহে ডেন্টাল প্লাকই দায়ী। ডায়াবেটিস রোগীদের যে সমস্ত কারণে প্লাক বৃদ্ধি পেতে পারে সেগুলো হচ্ছে— ১। ডায়াবেটিস রোগ দেখা দেয়ার পূর্বে যাদের মাড়ির প্রদাহ (Gingigities) বা দন্তবরক প্রদাহ (Periodontitis) থাকে তাদের প্রদাহ নিঃসৃত রস বৃদ্ধি পায় ফলে ডেন্টাল প্লাকও বাড়তে থাকে। ২। বৃহৎ ও ক্ষুদ্র লালা গ্রন্থি থেকে নিঃসৃত রস বৃদ্ধি পায় এবং তা খাদ্যকণার সঙ্গে মিসে প্লাক তৈরি করে। ৩। দাঁত দিয়ে খাদ্যদ্রব্য চিবানোর কর্মক্ষমতা যাদের কমে যায় (ডায়াবেটিস রোগীর মাড়ির সংক্রমণে) তাদের মুখেও প্লাকের পরিমাণ বৃদ্ধি পায়। ডায়াবেটিস রোগীদের খাদ্য নিয়ন্ত্রিত হয়। বেশির ভাগ ক্ষেত্রে মাড়ির ও দাঁতের ধারণ শক্তি ও প্রতিরোধ শক্তি কমে যায় ফলে খাওয়ার সময় ব্যথা অনুভূত হয়, তাই চিবিয়ে খাওয়ার প্রবণতাও হ্রাস পায়। এ সবের জন্যে ডায়াবেটিস রোগীদের প্লাক বৃদ্ধিও তাড়াতাড়ি হয় । ডায়াবেটিস রোগীদের রোগ নিয়ন্ত্রণে রাখতে যেমন তিনটি D মেনে চলতে হয় যথা D = Diet, D Drug D Discipline তেমনি ডায়াবেটিস রোগীদের মুখের রোগ প্রতিরোধেও তিনটি D মেনে চলা প্রয়োজন । খাদ্য (Diet) : প্রথমেই Diet বা খাদ্য নিয়ে আলোচনা করা যাক। বিজ্ঞানের গবেষণায় প্রমাণিত হয়েছে যে শর্করা বা চিনি জাতীয় খাদ্য গ্রহণের পর মুখ পরিষ্কার না হলে কিছু ক্ষণের মধ্যেই এক ধরনের অম্ল বা এ্যাসিড তৈরি হয় এবং তা দাঁতকে ক্ষয় করতে থাকে। এই ক্ষয় পদ্ধতির নামই ডেন্টাল ক্যারিজ। তাছাড়া খাদ্যকণা জমে থাকার যে আবরণ বা প্লাক সৃষ্টি হয় সেই প্লাক ধীরে ধীরে মাড়িকে আক্রমণ করে ফলে মাড়ির প্রদাহ বা দন্তাবরক প্রদাহ শুরু হয়। ডায়াবেটিস রোগীদের জন্যে দাঁত বা মুখের যত্নের কয়েকটি সতর্কীকরণ ইঙ্গিত : ১। সর্বপ্রথমই ডায়াবেটিস রোগটিকে নিয়ন্ত্রণে রাখবার চেষ্টা করা প্রয়োজন। রক্তের শর্করার পরিমাণ নিয়ন্ত্রণে রাখাই হচ্ছে দাঁত ও মাড়ির রোগ প্রতিরোধের অত্যন্ত প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ। মাড়ির অতিরিক্ত প্রদাহ অনেক সময় ডায়াবেটিসকে নিয়ন্ত্রিত রাখতে অনেক অসুবিধার সৃষ্টি করে। যদি কোনভাবে কখনো মাড়ির প্রদাহ শুরু হয় তবে ঐ ঘা শুকাতে অনেক দেরি হয় এবং এই দীর্ঘস্থায়ী প্রদাহের কারণেই একটি দাঁত হারাতে হয়। ২। প্রতি ছয় মাস অন্তর একজন ডেন্টাল সার্জনকে দিয়ে মুখ পরীক্ষা করা প্রয়োজন। ডেন্টাল সার্জনকে অবশ্যই আপনার ডায়াবেটিস রোগের কথা বলে রাখবেন। যাতে আপনার দাঁত ও মাড়ি সুস্থ থাকে সেই জন্যে ডেন্টাল সার্জন-এর কাছ থেকে আপনার মুখের যত্নের জন্যে কি কি করা প্রয়োজন তাও জেনে নেয়া প্রয়োজন । ৩। প্রতিদিন দুইবেলা সকাল ও রাতে দাঁত ব্রাশ এবং মাড়ির জন্যে প্রয়োজন একটি নরম টুথব্রাশ। ব্রাশটিকে উপরের পাটির দাঁত থেকে নিচের পাটির দাঁতে আবার নিচের পাটি থেকে উপরের পাটির দিকে, এভাবেই ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে দাঁত ও মাড়ি পরিষ্কার করা বিজ্ঞান সম্মত। দুই দাঁতের ফাঁক থেকে খাদ্যকণা বের করে দেবার জন্যে ডেন্টাল ফ্লস বা এক ধরনের সুতা ব্যবহার করা ভালো । ৪ । কখনো যদি আপনার মাড়ি থেকে দাঁত ব্রাশ-এর সময় বা খাবার খাওয়ার সময় রক্ত বের হয় তবে তা আপনার মাড়িতে প্রদাহের পূর্ব লক্ষণ কিনা বুঝবার জন্যে অবশ্যই একজন ডেন্টাল সার্জন-এর পরামর্শ গ্রহণ প্রয়োজন। মনে রাখবেন ডায়াবেটিস রোগ নিয়ন্ত্রণই অন্যান্য জটিলতা থেকে মুক্ত থাকবার একমাত্র চাবিকাঠি। অর্থাৎ আপনি যদি D= Diet, D=Drug, D= Discipline এই ত্রিরত্নের সাথে পরিচিত হতে পারেন তবে স্বাভাবিক মানুষের মতই জীবন যাপন করতে পারবেন। লেখক : দন্ত বিশেষজ্ঞ, সিনিয়র কনসালটেন্ট (অনারারি), বারডেম জেনারেল হাসপাতাল ও ইব্রাহিম মেডিকেল কলেজ, একুশে পদকপ্রাপ্ত চিকিৎসক

আরও দেখুন: