সনোলজিস্ট এবং গাইনেকোলজিস্ট হয়ে উঠার গল্প (পর্ব- ১)
গাইনেকোলজিস্ট ডা. তাসলিমা বেগম
১৯৯৯ সাল, আমার ইন্টার্ণ জীবন।
একজন সদ্য এমবিবিএস ভবিষ্যতে কি হতে যাচ্ছেন- আমার মনে হয় ইন্টার্ণ লাইফের ক্রিয়াকলাপই তা নিয়ন্ত্রণ করে। সে সময় সার্জারি বা গাইনী অপশন দেয়ার সুযোগ ছিল। মেডিসিন সবার জন্য বাধ্যতামূলক ছিল। স্বাভাবিক ভাবেই ঐ আমলে মহিলা হিসেবে গাইনীতেই ট্রেনিং করলাম। আমার এমবিবিএস পরীক্ষার ফলাফল প্রকাশিত হওয়ার আগেই বিশতম বিসিএসের সার্কুলার দেয়। এপেয়ারড সার্টিফিকেট দিয়ে বিসিএস অংশগ্রহণ করি এবং প্রিলিতে উত্তীর্ণ হই। আমাদের ২০ তম বিসিএস এর প্রিলি হয় মেডিসিনের ইন্টার্ণ থাকাকালীন এবং রিটেন হয় গাইনীতে ইটার্ন থাকাকালীন। আমাদের সময় অল্প কয়েকজনের মাত্র বিসিএস এ প্রিলি হয়েছিল। আর সেই সময় আমরা এত সিন্সিয়ারলি ওয়ার্ডে পড়ে থাকতাম, যে সিএ আমাদেরকে ডেকে নিয়ে বকা দিয়ে পড়তে বসতে বলতো।
বলা যায়- মেডিসিন ও গাইনীর সিএ এর অবদান আমার বিসিএস চাকুরি হওয়া। ইন্টার্ণীর শেষের দিকে বাংলাদেশ অ্যাটমিক এনার্জি কমিশনের আওতায় নিউক্লিয়ার মেডিসিনে মেডিকেল অফিসারের জন্য সার্কুলার দেয়। অবশেষে আমিসহ কয়েকজন আবেদন করি। ইন্টার্ণীর পর পরই আমাদের পরীক্ষা হয় এবং জানুয়ারি ২০০০ সনে চাকরির অ্যাপয়েন্টমেন্ট লেটার পাই।
ইতিমধ্যে আমি একটি এনজিও-তে বেশ ভালো স্যালারিতে কাজ করছিলাম। বাংলাদেশ পরিবার পরিকল্পনা সমিতির আন্ডারে ইউএনএফপি এর একটা রিপ্রোডাক্টিভ হেলথ এর প্রজেক্টে। সেলারি ছিল সেই সময় সরকারি চাকরির সেলারীর প্রায় তিন গুণ। এখন প্রশ্ন হলো আমি যেহেতু বিসিএসে ইতিমধ্যে রিটেনে সিলেক্টেড হয়ে গেছি এবং এনজিওতে এত ভালো সেলারি, এ চাকরি ছাড়বো কিনা। কারণ আমার পোস্টিং হয়েছিল পরমাণু চিকিৎসা কেন্দ্র ফরিদপুরে। বাসা তখন ছিল বরিশালে। এ অবস্থায় যদি জয়েন করি তবে ফরিদপুরে একা একা থাকতে হবে। আমার হাজবেন্ড এবং আমার আব্বা কোনমতেই রাজি ছিলেন না যে, মেয়ে হয়ে একা একা আমি ফরিদপুরে থাকি। আমাকে অনেক বুঝালেন যে, কয়দিন পরেই আমার বিসিএসের পোস্টিং হবে, কি দরকার এখানে জয়েন করার! আমি ইন্টার্ণীর সময়ই সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম যে, গাইনীতে ক্যারিয়ার করব। কারণ গাইনিতে কাজ করে আমার কাছে খুব রিয়াওর্ডিং মনে হতো। কি সুন্দর চিকিৎসা দিলে রোগীরা ভালো হয়ে যাচ্ছে, সবাই হাসিমুখে বিদায় নিচ্ছে, অর্থাৎ গাইনীতে চিকিৎসার ফলাফল খুব ইমিডিয়েটলি বুঝা যেত। একটু প্রটোকল ফলো করে চেষ্টা করলেই অনেক মৃতপ্রায় রোগির মুখে হাসি ফুটানো যায়। এ বিষয়টা আমাকে অনেক আকর্ষণ করতো ।
আমি ভেবে দেখলাম আমি যদি নিউক্লার মেডিসিনে বিসিএস হওয়া পর্যন্ত কিছুদিন চাকরি করি তবে আমি আল্ট্রাসনোগ্রাফি শিখে যাবো, যেটা আমি যদি গাইনোকোলজিস্ট হই তবে অনেক কাজ দেবে। তাই আমি ফরিদপুরে চাকুরিতে জয়েন করার ব্যাপারে নিজের সিদ্ধান্ত অটল থাকলাম। অবশেষে আমার হাজব্যান্ড আমাকে ফরিদপুরে জয়েন করার জন্য নিল এবং মেডিকেল কলেজের অন্যান্য শিক্ষকদের সাথে একটা ডরমেটরিতে আমার থাকার ব্যবস্থা হল। ওইখানে প্রায় ছয় সাত মাস চাকরি করেছিলাম। পুরা চাকরির সময়টা আমি খুব এনজয় করেছিলাম। জীবনের শুরুতে এভাবে একা থেকে আমার ভবিষ্যতে বিসিএস এর পোস্টিং এর ভয়ও দূর হয়ে গিয়েছিল। অবশ্য ৬-৭ মাস পরে পরমাণু চিকিৎসা কেন্দ্র বরিশালে বদলি হতে সমর্থ হই। বরিশাল আমার নিজের মেডিকেল, নিজের জায়গা মনে হতো, তাই ওখানে আনন্দের সাথে চাকরি করতে থাকলাম। আমার মেডিসিনের প্রফেসর স্যার চাইতেন আমি মেডিসিনে ক্যারিয়ার করি। ওনার মতে আমার মেধা মেডিসিন বিশেষজ্ঞ হলে বেশি কাজে আসবে। আমাকে খুব ফেবার করতেন। উনি একদিন ডেকে নিয়ে বললেন, তুমি সময়টা নষ্ট করো না নিউক্লিয়ার মেডিসিনের চাকরি পাশাপাশি আড়াই টার পরে মেডিসিন ওয়ার্ড এ কাজ কর, রাতে ছাত্র পড়াও। তোমার অভিজ্ঞতা হবে, ট্রেনিং সার্টিফিকেট ও পাবে। আসলে বরিশালে তখন অনেক ট্রেনিং পোষ্ট ফাঁকা ছিল, সন্ধ্যার পর ছাত্র পড়ানোর রেওয়াজ থাকলেও শিক্ষকের ক্রাইসিস ছিল। তাই স্যার আমাকে দিয়ে কিছু কাজ করাতে চেয়েছিলেন।
কিন্তু আমি গাইনীতে কেরিয়ার করার ব্যপারে ডিটারমাইন্ড থাকায় ঐ পথে আর যাইনি।
(চলবে)
লেখক: ডা. তাসলিমা বেগম
এফসিপিএস (গাইনী), এফসিপিএস (ইনফার্টিলিটি)
সহযোগী অধ্যাপক ও বিভাগীয় প্রধান
ইনফার্টিলিটি ইউনিট, চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ।