চিকিৎসকদের হিটস্ট্রোক ঠেকাবে কে?
হিটস্ট্রোক (ডা. রাসেল চৌধুরী)
২০০৯ সালের গ্রীষ্মকাল। মাস কয়েক আগে বিসিএস দিয়ে সরকারি চাকরিতে ঢুকেছি। উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স রামগঞ্জ, লক্ষ্মীপুরে মেডিকেল অফিসার হিসেবে কাজ করছি।
সারাদিনে ২৪ ঘন্টায় ১০ ঘন্টাও বিদ্যুৎ থাকতো না। জেনারেটরের তেল বরাদ্দ নেই। ভ্যাপসা গরমে ঘেমে নেয়ে আউটডোর ইনডোরে রোগী দেখতাম। মাঝে মাঝে ঘামের ফোঁটা টপটপ করে রোগীর ব্যবস্থাপত্রে পড়তো। অথচ ইনডোরের রোগীদের জন্য সান্ধ্যকালীন সময়ে বাইরের জেনারেটর থেকে বিদ্যুৎ সরবরাহের জন্য আমরা চিকিৎসকরা ৫০০ টাকা করে চাঁদা দিতাম।
দুই বছর সেখানে ছিলাম, এভাবেই বিদ্যুৎবিহীন গরমে ঘেমে নেয়ে হাসপাতালে ডিউটি করতাম, কোয়ার্টারে থাকতাম।
এরপর গেলাম লক্ষ্মীপুর জেলা সদর হাসপাতালে ইমার্জেন্সি মেডিকেল অফিসার হিসেবে। সেখানে দুপুর ২.৩০ টা থেকে সকাল ৮ টা পর্যন্ত ইনডোরে ২০০+ রোগী এবং আউটডোর ইমার্জেন্সির ৫০+ রোগীর জন্য চিকিৎসক শুধু ইএমও। অথচ সেই চিকিৎসকের একটা রুমেও এসি দূরে থাক প্রায়ই জেনারেটরের বিদ্যুৎও থাকতো না। চলেছে ডিউটি সেখানেও ঘেমে নেয়ে।
উচ্চশিক্ষার জন্য চলে এলাম খোদ রাজধানী শহরে। মিটফোর্ড হাসপাতালে।
প্রথমে ছিলাম মেডিসিন আউটডোরে। প্রতিদিন ১৫০+ রোগী, ওভেনের মতো সিদ্ধ হতে হতে রোগী দেখতাম। পরিচালক মহোদয় মাঝে মাঝে রাউন্ডে এসে দেখতেন আমরা ঠিকমতো কাজ করছি না। অথচ এসি রুমে সারাদিন কাটানো পরিচালক কোনোদিন ভাবেননি কিভাবে এখানে রোগী দেখা সম্ভব! মাঝে মাঝে তাই আরপি Amiruzzaman Suman ভাইয়ের রুমে যেয়ে একটু এসির বাতাস খেতাম।
কয়েক মাস আউটডোর শেষ করে উচ্চশিক্ষার ট্রেনিং করতে এলাম শিশু বিভাগের ইনডোরে। এখানে রুমে জেনারেটর সুবিধায় বিদ্যুৎ থাকতো কিন্তু কয়েকজন সহকারী রেজিস্ট্রারের শেয়ার করা ঘুপচি ভেন্টিলেশনবিহীন রুমে একটা এসি দেয়া হয়নি। ৩ বছর এভাবেই কাটলো।
এর মাঝে হার্ট এটাক হলো, বাইপাস অপারেশন হলো। স্টার্নোটমি করা (হার্টের বাইপাস সার্জারির সময় বুকের মাঝের পাঁজর কেটে স্টিলের তার দিয়ে সেলাই করা হয়) বুক নিয়ে মাটিতে ঝুঁকে গরমে ঘেমে নেয়ে রোগী দেখতাম। তাই রাতের ডিউটির সময় মাঝে মাঝে ঘুপচি রুমের ভেতর শুধু গেঞ্জি গায়ে শুয়ে থাকতাম।
এরপর এমডি কোর্স শেষ করতে ঢাকা শিশু হাসপাতালে এলাম। এখানে গরমকালে ইভিনিং নাইট করতে হতো সেই একই রকম ঘুপচি ভ্যাপসা রুমে। প্রায় পুরো হাসপাতালের চিকিৎসকরা এসি রুমে থাকলেও তরুণ ট্রেইনিদের বিকাল রাত্রির ডিউটি স্টেশন এই ৬-৭ টা রুমে এসি দেয়ার কথা কেউ ভাবেনি।
এরপর পাশ করে করোনার মাঝে দুই বছর স্যার সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজে ২ বছর বায়োকেমিস্ট্রি পড়িয়েছি। লেকচারারদের রুম ছিলো ৪ তলায় টপ ফ্লোরে। গরমকালে দুপুর ১২ টা থেকে ২.৩০ টার ক্লাসে ৬০+ শিক্ষাক্ষার্থীর ক্লাস পরীক্ষা নিতে গিয়ে মনে হতো দম আটকে মরা যাবো। সারাদিন এসিতে কাটানো অধ্যক্ষরা কোনোদিন ভাবেনি লেকচারারদের দুইটি রুমে এসি দেয়া হোক।
প্রমোশন পেয়ে জুনিয়র কনসালটেন্ট হলাম। আবার ফিরে এলাম উপজেলায়। এখানেও একই অবস্থা। হাসপাতালের ২য় তলায় টপফ্লোরে একটা রুম তিনজন কনসালটেন্ট শেয়ার করে বসি। অথচ হাসপাতালের জেনারেটর নষ্ট, সেটা ঠিক হলে আবার তেল নেই। এই চল্লিশোর্ধ বয়সে বিদ্যুৎবিহীন অবস্থায় হিট স্ট্রোক হয় হয় অবস্থা। তিন কনসালটেন্ট অনেক বলে কয়ে এক ঔষধ কোম্পানির কাছ থেকে একটা আইপিএস নিয়েছি গত বছর। অথচ একটা এসি সরকার আমাদের দিতে পারেনি।
চাকরির বয়স ১৬ বছর চলছে। ৬ষ্ঠ গ্রেডের কনসালটেন্টদের জন্য গরমকালে সেই একই পরিবেশ ৯৫% উপজেলায়। সেই ১৬ বছর আগের মেডিকেল অফিসারের মতোই ঘেমে নেয়ে দম বন্ধ হয়ে যাবার মতো কঠিন অবস্থায় কাজ করে যাচ্ছি। কিন্তু ১৬ বছর আগের সেই শরীরতো এখন আমার বা আমার সহকর্মীদের নেই।
অবশ্য এর মাঝে এসি পাজেরোতে করে কোট গায়ে পরিদর্শনে এসে একবার এক ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ ধমক দিয়ে গেছেন, কেনো এই গরমেও এপ্রোন পরছি না!! এপ্রোন পরতে নাকি আমাদের লজ্জা লাগে!!
হিটস্ট্রোকে বাঁচতে প্রতিদিন স্বাস্থ্য বার্তা দেয়া হচ্ছে। অথচ কয়েক লক্ষ টাকা বাজেটের দেশে প্রতিদিন লক্ষ লক্ষ রোগীকে এই গরমে চিকিৎসা দেয়া জেলা উপজেলা, মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের সরকারি চিকিৎসকদের হিটস্ট্রোক ঠেকাতে নিরবিচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ বা এসি সরবরাহ করার কথা কারো মাথায় আজো আসে নাই।
হিটস্ট্রোকে চিকিৎসা সেবা দিয়ে জীবন বাঁচাবে চিকিৎসক কিন্তু চিকিৎসকদের হিটস্ট্রোক ঠেকাবে কে?
বি:দ্র: উগান্ডার অদক্ষ ও দুর্নীতিপরায়ণ ব্যাংকারদের কারণে ধুঁকতে থাকা এক সরকারি ব্যাংকের ছোট ব্রাঞ্চে গিয়ে দেখি সেখানকার পিয়নসহ সবাই সেন্ট্রাল এসিতে বসে কাজ করছে।
লেখকঃ
ডা. রাসেল চৌধুরী
এমবিবিএস, বিসিএস, এমডি (শিশু)
জুনিয়র কনসালটেন্ট (শিশু)।