ছাত্র থেকে শিক্ষক হয়ে ওঠার গল্প

ডা. গুলজার হোসেন
2023-10-17 11:32:37
ছাত্র থেকে শিক্ষক হয়ে ওঠার গল্প

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ে হেমাটোলজি বিভাগের সহকারী অধ্যাপক পদে নিয়োগপত্র তুলে দেন ভাইস চ্যান্সলর অধ্যাপক ডা. শারফুদ্দিন আহমেদ (ইনসেটে ডা. গুলজার হোসেন)

অবশেষে আমি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ে হেমাটোলজি বিভাগের সহকারী অধ্যাপক পদে নিয়োগ পেলাম।

বিশ্ববিদ্যালয়ের চাকরি বরাবরই আমার কাছে ছিল আকর্ষণীয়। কিন্তু নানাকারণেই মনে হত এ'তো সোনার হরিণ। সবার কপালে এসব জোটেনা। মেনে নিয়েছিলাম এসব আমার জন্য নয়। আমি ছা পোষা, সাধারণ। আমি এভারেজ। আমি কেউকেটা নই।

উচ্চতর পড়াশুনার সুবাদে ছাত্র হিসেবে এই বিশ্ববিদ্যালয়ে কাটিয়ে দিলাম অনেকগুলো বছর। তারপর পাশ করে একদিন মনে হলো এখানেই শিক্ষক হিসেবে এলে মন্দ হয়না। ২০১৯ সালে আবেদন লিখেও শেষ অবধি জমা দেইনি। ২০২০ সালে আবার দিলাম। নির্বাচিত হইনি। ভাইভা বোর্ডেই একজন পরীক্ষক বললেন "তুমি তো মাত্র পাশ করেছ।"
তারপর ২০২২ সালে আবার এপ্লাই করলাম।
আজ তার নিয়োগপত্র পেলাম।

একটা আনন্দঘন ও আবেগঘন দিন ছিল আমাদের জন্য। যার কারণে আজকের এই দিনটি এতটা আনন্দমুখর হয়েছে তিনি হলেন আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের মাননীয় ভিসি অধ্যাপক শারফুদ্দিন আহমেদ স্যার৷ স্যারের প্রতি আন্তরিক কৃতজ্ঞতা জানাই।

শুরুতে 'অবশেষে' বললাম এই কারণে যে এই পথটি মসৃণ ছিলনা৷ বাধা ছিল, প্রতিবন্ধকতা ছিল। যত বাধা পাচ্ছিলাম ততই জেদ চেপে যাচ্ছিল। শেষে বেরিয়ে এলাম আমার নিজস্ব গন্ডি ছেড়ে৷

একটা মনস্তাত্ত্বিক যুদ্ধই ছিল আসলে। এই যুদ্ধে আমার শক্তি যিনি ছিলেন তিনি হলেন Sabuj Shahidullah ভাই। মেডিকেল সেক্টরে আমি এই মানুষটাকে গুরু বলে মানি।

সেই ২০০৯ সাল থেকে উনাকে মূগ্ধ হয়ে দেখি। একজন মানুষ সবদিকে কতটা ব্যালেন্সড হতে পারেন!

Rasul Amin শিপন ভাই আর Md Rassell ভাইএর কথা বলতে হবে আলাদা করে। খুব অল্প সময়ে মানুষগুলো আমাকে আপন করে নিলেন। গত ছয়মাসে এঁরা আমার পাশে ছিলেন সবচেয়ে কাছের মানুষ হয়ে ভাইয়ের মত, পরম বন্ধুর মত। আমি যেন তাঁদের কথা কখনো ভুলে না যাই৷

আমার বন্ধু Mohammad Faisal। তার আন্তরিক অভিব্যক্তি আমাকে শক্তি দিয়েছে।

যখন এমডি কোর্সের ছাত্র ছিলাম তখন থেকেই অধ্যাপক শারফুদ্দিন আহমেদ স্যার আমাকে বিশেষ স্নেহের চোখে দেখতেন। দেখা হলেই বলতেন "আমি তোমার গান খুব পছন্দ করি।" একবার ওএসবির অনুষ্ঠানে নিয়ে গেলেন গান গাইতে। স্যার তখন সোসাইটির প্রেসিডেন্ট সম্ভবত। গান শেষে নিজে ছুটে এসে বললেন " তুমি কিন্তু দারুন গেয়েছ"।

২০১৯ সালের বিশ্ববিদ্যালয় দিবসে থিসিসের জন্য যখন এওয়ার্ড পেলাম স্যার আমাকে ডেকে বলেছিলেন "এখানে সার্কুলার হলে ঢুকে যেও। তোমার মত লোক দরকার।" তখন তিনি প্রোভিসি (শিক্ষা)। কিভাবে যেন ইচ্ছাটা ঢুকিয়ে দিলেন তিনি আমার মধ্যে। দারুন ইন্সপিরেশন ছিল সেটা। ভাবিনি উনার হাত দিয়েই একদিন নিয়োগপত্র পাবো।

সমস্যা হচ্ছে এখন ভিসি হয়ে যাবার পর স্যারকে নিয়ে সেসব স্মৃতি চারণ খুব ক্লিশে হয়ে যায়। যেমন আমাদের কুমিল্লা মেডিকেল কলেজের ক্যাম্পাস জীবনের নায়ক, আমার ছাত্র জীবনের সবচেয়ে ক্যারিশম্যাটিক, সদ্য পোস্ট গ্রাজুয়েশন সম্পন্ন করা তরুন শিক্ষক খুরশিদ স্যারকে নিয়ে কিছু বলতে গেলেই কোথায় যেন বাধে। যে মানুষটা আমার গানের রুচি তৈরি করে দিয়েছিলেন, নিজে হাতে অসংখ্য ক্যাসেট আর সিডি রেকর্ড করে দিয়েছিলেন, জীবনে প্রথম আমাকে গীতবিতান কিনে দিয়েছিলেন, অনেক ব্যাস্ততার পরও আমার প্রথম সিডি উদবোধন করে দিয়েছিলেন সেই একান্ত আপন মানুষটাকে নিয়ে আমি ফেসবুকে তেমন কিছুই লিখতে পারিনা। ডিজি স্যারকে নিয়ে এসব লেখা আসলে উচিতও না।
তাই এখানেই থামছি।

ঢাকায় আমার জীবন শুরু করেছিলাম পরিবারের ছয়জন মানুষকে নিয়ে। এখন চারজন। দুজন চলে গেলেন একে একে।

আজ আব্বাকে খুব মনে পড়ছে। আম্মাকেও। খুব করুন আর গভীরতম বেদনার মত মনে পড়ছে৷

আজ সন্ধ্যায় ক্লিনিকে আমার জুনিয়র ডক্টররা বলছিলো " স্যার আপনার অনুভুতি কেমন?" আমার ইচ্ছে হয়েছিল বলি " বাবা মা চলে যাবার পর জীবনের কোন আনন্দই আর আগের মত স্বাদের হয়না।"

তবু আমি জীবনবাদী মানুষ। আনন্দই আমার জীবনের মূল শক্তি। আজ তবে আনন্দই হোক। আমার পরিবারের সকল সদস্যর প্রতি আমার কৃতজ্ঞতা৷

শেষে আসল কথাটা বলি। আমি আসলে ''পিউর শাহবাগী''। শাহবাগ আমাকে ছাড়েনা। শাহবাগ আমার মায়া কাটাতে পারলোনা। সেই এমফিল কোর্সে ঢুকেছিলাম ২০০৮ সালে৷ এরপর থেকে ঘুরে ফিরে শাহবাগেই আটকে রইলাম।

লেখকঃ

ডা. গুলজার হোসেন
সহকারী অধ্যাপক, হেমাটোলজি বিভাগ, 
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়।  


আরও দেখুন: