মায়েদের রোগ : জরায়ুমুখ ক্যান্সার
মায়েদের রোগ : জরায়ুমুখ ক্যান্সার - লিখেছেন ডা. উম্মে হুমায়রা কানেতা
"আমি ভীষণ ভালবাসতাম আমার মাকে,
কখনো মুখ ফুটে বলিনি।
টিফিনের পয়সা বাঁচিয়ে কখনো কখনো কিনে আনতাম কমলালেবু,
শুয়ে শুয়ে মার চোখ জলে ভরে উঠত।
আমার ভালোবাসার কথা মাকে কখনো আমি মুখ ফুটে বলতে পারিনি।"
কবি সুভাষ মুখোপাধ্যায় এর মত আমরাও কখনো কি স্বীকার করি আমাদের মায়ের প্রতি অকৃত্রিম ভালোবাসার কথা?
যেই মা আমাদেরকে নয় মাস গর্ভে ধারণ করেছে, আমাদের জন্ম দিয়েছেন তীব্র প্রসব বেদনা উপেক্ষা করে, ধীরে ধীরে আমাদেরকে বড় করে তুলেছেন, আমাদের প্রথম শিক্ষক- সেই মায়ের জন্য,তার সুস্বাস্থ্যের জন্য আমরা সন্তানরা কতটুকু চিন্তা করি? আমাদের সবার জন্মস্থান আমাদের মায়ের জরায়ু -তার যত্নের জন্য, তাকে ভয়াবহ মরন ব্যাধি জরায়ু মুখ ক্যান্সার থেকে রক্ষার জন্য?
জানুয়ারি মাস-জরায়ুমুখ ক্যান্সার সচেতনতার মাস হিসেবে সারা বিশ্বে পালিত হয়ে আসছে।
জরায়ুর ক্যানসার বা জরায়ু মুখ ক্যান্সার- যাকে ইংরেজিতে বলা হয় সার্ভাইকাল ক্যানসার, নারীদের জন্য এক ভয়াবহ মরণব্যাধি। বিশ্বব্যাপী নারীদের মৃত্যুর অন্যতম প্রধান কারণ হলো এই ক্যান্সার। উন্নয়নশীল দেশের মহিলাদের মাঝে যেসব ক্যান্সার অধিক পরিমাণে দেখা যায়,তার মধ্যে এটি দ্বিতীয়। আমাদের মতো উন্নয়নশীল দেশের ক্যান্সার আক্রান্ত নারীদের শতকরা ৩০ ভাগই হচ্ছেন জরায়ুমুখের ক্যান্সারের শিকার। নারীদের চতুর্থ সর্বাধিক ক্যান্সার এবং ক্যান্সারজনিত মৃত্যুর দশম সর্বাধিক কারণ এই জরায়ুর ক্যান্সার।
বাংলাদেশে প্রতিবছর জরায়ুমুখ ক্যান্সারে প্রায় ৬ হাজারেরও বেশি নারী মৃত্যুবরণ করেন এবং প্রতিবছর ১২ হাজারেরও বেশি নারী নতুনভাবে চিহ্নিত হন।আবার যে কোন সময় এই রোগে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি বহন করে চলছেন প্রায় ৬০ মিলিয়ন নারী। বিশ্বে প্রতি দুই মিনিটে একজন নারী জরায়ুমুখ ক্যান্সারে মৃত্যুবরণ করেন এবং প্রতিবছর প্রায় ৫০ লক্ষাধিক নারী নতুন করে আক্রান্ত হন।
আশ্চর্যজনক কথা হল, আমরা অনেকেই জানিনা রোগটি প্রতিরোধ সম্পর্কে, এ রোগটি কেন হয়, এর লক্ষণ কি, এর চিকিৎসা কি -এনিয়ে সাধারন জনগনের জ্ঞান খুবই নগণ্য।বিশেষ করে নিম্নবিত্ত শ্রেণীর মানুষেরা -যাদের মধ্যে এ রোগের ঝুঁকি অনেক বেশি, তারা ও এ সম্পর্কে কিছুই জানেন না। ফলাফল- হাজারো মায়ের অকালে মৃত্যু। কিন্তু ৯০ ভাগ ক্ষেত্রে শুধুমাত্র সচেতনতা বৃদ্ধির মাধ্যমে এই ভয়াবহতা প্রতিরোধ করা সম্ভব।
খুব অল্প করে আজ এই সম্পর্কে আপনাদের জানানোর প্রচেষ্টা -
প্রথমে জেনে নেয়া যাক, কাদের হয় এই ক্যান্সার??? জরায়ু ক্যান্সার ১৫ থেকে ৪৫ বছর বয়সী নারীদের মধ্যে বেশি দেখা যায়, কিন্তু ক্যান্সারের লক্ষণ প্রকাশের প্রায় ২ থেকে ২০ বছর আগেই একজন নারী এই রোগের ভাইরাস দ্বারা আক্রান্ত হন।
সাধারণত অনুন্নত এবং উন্নয়নশীল দেশের নারীরা স্বাস্থ্য বিষয়ে সম্পূর্ণ সচেতন না অথবা বিভিন্ন পারিবারিক এবং সামাজিক বাধা-বিপত্তির জন্য এই রোগের বিস্তার এবং এই রোগের প্রতিরোধ সম্পর্কে তারা কোন কথা বলেন না, অন্যদিকে উন্নত দেশের নারীরা এ বিষয়ে খুবই সচেতন এবং উন্নত জীবনযাপনের কারণে তারা অনেকটাই নিরাপদ থাকেন।
কেন হয় এই জরায়ুমুখ ক্যান্সার?
এর সুনির্দিষ্ট কারণ সম্পর্কে এখনও নিশ্চিত ভাবে জানা যায়নি, তবে ৮০ থেকে ৯০ ভাগ ক্ষেত্রে এর কারণ হচ্ছে-
* হিউম্যান প্যাপিলোমা ভাইরাস (HPV), যেটা যৌন সংযোগের মাধ্যমে সংক্রমণ ঘটায়। সংক্রমনের এক যুগেরও বেশি সময় ধরে জরায়ুমুখের স্বাভাবিক কোষ পরিবর্তিত হতে থাকে এবং একসময় তা ক্যানসারে রূপ নেয়। প্রায় ১০০ রকমের হিউম্যান প্যাপিলোমা ভাইরাস আছে, যার মধ্যে হিউম্যান প্যাপিলোমা ভাইরাস ১৮ এবং১১ খুবই মারাত্মক। অন্যান্য কারণ সমূহের মধ্যে রয়েছে-
* বাল্যবিবাহ
* অল্প বয়সে প্রথম সন্তান প্রসব
* অধিক সন্তান প্রসব
* স্থুলতা
* বয়স ৩০ থেকে ৪৫ বছর, তবে যে কোন বয়সেই হতে পারে
* হরমোনের ভারসাম্যহীনতা
* দীর্ঘদিন যাবৎ জন্মনিয়ন্ত্রণ বড়ি সেবন
* নিয়মিত নারীদের স্বাস্থ্য চেকআপ না করানো
* শারীরিক রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কম থাকা
* একাধিক সেক্সচুয়াল পার্টনার থাকা।
লক্ষণ সমূহ কি কি?
প্রথম দিকে এই রোগের তেমন কোনো উপসর্গ না-ও হতে পারে এবং এই রোগের যে প্রিক্যান্সারাস পিরিয়ড, তখন ও কোন রকমের কোন উপসর্গ পরিলক্ষিত হয় না। তবে যখন একটু এডভান্স পর্যায়ে থাকে, তখন লক্ষ্মণ সমূহের মধ্যে অন্যতম হলো-
▪️ অনিয়মিতভাবে মাসিকের রাস্তা দিয়ে রক্তপাত হওয়া
▪️ সহবাসের পরে ব্যথা অথবা রক্তপাত হওয়া
▪️ অধিক পরিমাণে সাদাস্রাব যাওয়া
▪️ তলপেটে ব্যথা হওয়া ইত্যাদি
প্রতিরোধঃ
খুবই প্রাথমিক পর্যায়ে রোগটি শনাক্তকরণের জন্য কিছু প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা আমরা খুব সহজেই নিতে পারি।
প্রথমেই রয়েছে আচরণগত প্রতিরোধঃ
বাল্যবিবাহ রোধ করা এবং অল্প বয়সে প্রথম সন্তান প্রসবের থেকে বিরত রাখা, প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ ধূমপান থেকে বিরত থাকা, সাদা পাতা- দাঁতের গোড়ায় গুল ব্যবহার না করা, সুষম খাদ্য গ্রহণ, শাকসবজি -ফলমূল খাওয়ার অভ্যাস পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন, স্বাস্থ্যসম্মত, সুশৃংখল, ধর্মীয় অনুশাসনের মধ্যে জীবন যাপন করা - এসবই খুব সহজে ভাইরাসের সংক্রমণ থেকে আমাদেরকে রক্ষা করতে পারে।
পাশাপাশি নিয়মিত স্ক্রিনিং পরীক্ষার মাধ্যমে এই ক্যানসারের আক্রমণ হার কমিয়ে আনা সম্ভব এবং ১০ বছর বয়সের পর থেকেই জরায়ু ক্যান্সার প্রতিরোধের টিকা নেওয়া যায়, যার মধ্যে রয়েছে তিনটি ডোস। প্রথম ডোস- প্রথম ডোসের এক মাস পর দ্বিতীয় ডোজ এবং প্রথম ডোসের ছয় মাস পরে তৃতীয় ডোস।
নিয়মিত স্ত্রী রোগ বিশেষজ্ঞ ডাক্তার এর পরামর্শ নেওয়া, চেক আপ করা খুবই জরুরি।
স্ক্রিনিং পদ্ধতিঃ
ভায়া টেস্ট অথবা প্যাপ টেস্ট ঃ ব্যথামুক্ত এবং খুবই সাশ্রয়ী পরীক্ষা যার মাধ্যমে খুব সহজে এ রোগ সনাক্ত করা যায়। সাধারণত বিবাহিত নারীরা ৩০ বছরের পর থেকে এ পরীক্ষা করে থাকেন।
বাংলাদেশ সরকার জরায়ু মুখ ক্যান্সার প্রতিরোধে সামাজিক সচেতনতা বৃদ্ধির জন্য কাজ করে যাচ্ছে৷ সরকারি জেলা সদর হাসপাতালে, উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স -এ ভায়া টেস্ট এর ব্যবস্থা আছে। আগামীতে ভ্যাক্সিন আমদানি করা এবং সরকারিভাবে তা বিতরণ এর জন্য কাজ করা হচ্ছে।
সরকারের এ কাজে বিভিন্ন সামাজিক সংগঠন ও মানুষের কাছে বার্তাগুলো পৌঁছে দিতে নিরলসভাবে কাজ করে যাচ্ছে।
তাই আসুন, সবাই আজ সবার নিজের মা, স্ত্রী,বোন ও কন্যাসন্তান কে এই ব্যধি সম্পর্কে অবগত করি।
সবাই মিলে চেষ্টা করি।